×

সারাদেশ

বন্যার অবনতি দশ জেলায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২০, ০৯:৫২ এএম

বন্যার অবনতি দশ জেলায়

টানা দুই দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। গতকাল ফুলগাজী থেকে তোলা ছবি -ভোরের কাগজ

 লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় নদীর দুই পাড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে করা হয়েছে মাইকিং। এদিকে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে যমুনা, সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা, সুনামগঞ্জে সুরমা ও পিয়াইন, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, নীলফামারী ও রংপুরে তিস্তার পানি বেড়ে শত শত গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্দি রয়েছেন অন্তত ১০ লাখ মানুষ। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়ও অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। খাদ্য ও খাবার পানির সংকটে দুর্ভোগ আরো বেড়ে গেছে তাদের। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফলে জেলার ৫ উপজেলায় তিস্তা ও ধরলার তীরবর্তী এবং চরাঞ্চলের দেড় লক্ষাধিক মানুষ আবারো পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া তিস্তা ব্যারাজ রক্ষা ফ্লাড বাইপাস সড়কটি হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৬ সালে তিস্তার ভয়াবহ বন্যার পর ২০২০ সালে একই রকম বন্যা দেখা দিয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, রবিবার রাতে পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে। সেই কারণে রেড অ্যালার্ট জারির পাশাপাশি নদীর চরাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। তবে সোমবার সকালে পানি কিছুটা কমে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্যারাজটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সিংঙ্গীমার ইউনিয়নের তিস্তা নদীর চর ধুবনীর এক বাঁধ ভেঙে গিয়ে প্রায় ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাটিকাপাড়া ও সিন্দুর্না ইউনিয়নের প্রায় তিন শতাধিক পারিবারে ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব পরিবার স্থানীয় বাঁধের রাস্তায় তাঁবু টাঙিয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ১২০ টন খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতি উপজেলার নির্বাহী অফিসাররা ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। জামালপুর : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি আবারো অবনতি হয়েছে। এতে জেলার ৪০ ইউনিয়নের ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নতুন করে বন্যাকবলিত হওয়ায় পানিবন্দি এসব মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অভিযোগ, গত ৩ দিন ধরে নতুন করে বন্যাকবলিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি তারা। তবে জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে। বানভাসি মানুষের মাঝে পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানিয়েছেন, সোমবার বিকাল ৩টায় যমুনার পানি বাহাদুরবাদঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহ পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। সিলেট : সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সব নদ-নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। আর এতে দুর্ভোগ বাড়ছে পানিবন্দি সাধারণ মানুষের। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত দুটি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে রয়েছে সুরমা। এর মধ্যে কানাইঘাট পয়েন্টে ৭৬ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার ও আমলসিদে ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শ্যাওলা ও শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও রয়েছে বিপদসীমার খুব কাছাকাছি। অন্যদিকে গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লোভা ও ধলাই নদীতেও গত ২৪ ঘণ্টায় পানি কমার কোনো আলামত নেই। আর এ কারণে বানের পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে সিলেট সদর উপজেলা, গোয়াইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ ও জকিগঞ্জের নিম্নাঞ্চল। এছাড়াও সুরমা পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সিলেট নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় সৃষ্ট এ বন্যায় জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সুনামগঞ্জ : জেলার হাওরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে এখনো বিপদসীমার ৩১ সে.মি. উপর দিয়ে বইছে। ফলে পৌর শহরের আবাসিক এলাকাগুলো নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। শহরের উপর দিয়ে চলাচল করছে ছোট ছোট নৌকা। জেলার ছাতকেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ইতোমধ্যেই বহু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েক লাখ পানিবন্দি মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চললেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। সুরমার পাশাপাশি চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ছাতক-গোন্দিগঞ্জ-সিলেট, ছাতক-সুনামগঞ্জ, ছাতক-জাউয়া, ছাতক-দোয়ারা সড়কের বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে জেলা সদরসহ দেশের সব অঞ্চলের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ : গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ সে.মি. বেড়ে সোমবার সকাল ৬টায় সিরাজগঞ্জ জেলা পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩ সে.মি. উপরে ছিল। এছাড়া কাজিপুর উপজেলা পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ২০ সে.মি. বেড়ে বিপদসীমার ২৬ সে.মি. উপরে রয়েছে। সিরাজগঞ্জের পাউবোর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) শাখার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি) এ কে এম রফিকুল ইসলাম বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সোমবার সকালে জানান, যমুনায় আগামী ৭২ ঘণ্টা পানি বাড়তে পারে। দ্বিতীয় দফায় যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় জেলার সদর, কাজিপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও শাখাগুলোতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলও প্লাবিত হচ্ছে। স্থায়ী বন্যার আশঙ্কায় অনেকেই আশপাশের বাঁধে ও উঁচু স্থানে আশ্রয়ের পরিকল্পনা করছেন। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, এর মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) : উজানের ঢল আর স্থানীয়ভাবে প্রবল বর্ষণে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হুহু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ১৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় ওই সব গ্রামের মানুষ গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ফুলছড়ি উপজেলার সৈয়দপুর ঘাট থেকে বালাসীঘাট পর্যন্ত পুরনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় আবারো ভাষারপাড়া ও মাঝিপাড়া গ্রামের অনেক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। এ কারণে এলাকার লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যার পানিতে গাইবান্ধা-বালাসী সড়কের আধা কিলোমিটার এলাকা আবারো তলিয়ে গেছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার উত্তর উড়িয়া, রতনপুর, কাবিলপুর, ভাষারপাড়া, রসুলপুর, খলাইহাড়া, মাঝিপাড়া, ছাতারকান্দি, বাজে তেলকুপি, বুলবুলির চর, কাউয়াবাধা, উজালডাঙা, কৃষ্ণমনি, পূর্ব খাটিয়ামারী, জিয়াডাঙা, নামাপাড়া গ্রামের লোকজনের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। ডিমলা (নীলফামারী) : নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দিন দিন বেড়েই চলছে পানিবন্দির সংখ্যা। সোমবার তিস্তা অববাহিকায় বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার মানুষ। উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণের ফলে তিস্তার পানি সকাল ৬টায় বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যা ও ভাঙনের কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া বিভাগের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (পাউবো)। পীরগাছা (রংপুর) : রংপুরের পীরগাছায় কয়েক দিনের অতিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি বেড়ে গতকাল সোমবার কয়েকটি এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এদিকে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ায় বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও গবাদিপশু নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন পানিবন্দি এলাকার মানুষ। তিস্তা নদীর বাঁধ ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন কয়েক হাজার মানুষ। বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষজন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ৫টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় পানিবন্দি হয়ে অনেকেইে পরিবার শিশু-বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে রয়েছে বিপাকে। বানের পানিতে ভেসে গেছে শত শত মৎস্যচাষির সোনালি স্বপ্ন। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় আনুমানিক ৪১ হেক্টর জমির ফিশারি ও পুকুর তলিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্যচাষিরা। উপজেলা চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিম বলেন, ধোবাউড়া উপজেলার পানিবন্দি মানুষের জন্য আমরা খাবারের ব্যবস্থা করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফিকুজ্জামান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App