×

জাতীয়

প্রতারক সাহেদের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২০, ০৯:২৩ এএম

আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রতারক মো. সাহেদ করিম কোথায় আছেন এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে। পরিবার ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তার অবস্থান আঁচ করা গেছে বলে জানা গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। তিনি পলাতক না কোনো বাহিনীর হেফাজতে আছেন এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধু¤্রজাল। কাগজে-কলমে সাহেদের পেশা একটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং সমাজসেবক বলে পরিচয় দিলেও তিনি একেকজনের সামনে নিজের একেক পরিচয় তুলে ধরতেন। নিজেকে কখনো ‘প্রধানমন্ত্রীর পিএস (একান্ত সচিব)’, আবার কখনো সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দিয়ে লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টকশো করে বিশ্লেষক পরিচিতি পাওয়া সাহেদ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বনানীর আলোচিত হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১/১১ এর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তিনি জার্সি বদল করে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বলে নিজের পরিচয় দেন। এরপর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি টকশোতে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বন্দনা করে অনেকের প্রিয়ভাজন হন। বাগিয়ে নেন দলের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক পদ। পাশাপাশি সচিবালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, বিভিন্ন গোয়েন্দা দপ্তর ও মন্ত্রীপাড়ায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। ‘টকশো ব্যক্তিত্ব’ পরিচিতিকে পুঁজি করে তিনি প্রতারণার সিঁড়ি তৈরি করেন। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকা কেউ ফেরত চাইতে গেলে তাকে অফিসে আটকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীদের দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। গত কয়েক দিনে র‌্যাব ও পুলিশের কাছে শতাধিক ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগ তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এদিকে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পলাতক রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের ‘অবৈধ’ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার কমিশনের এক সভায় সংস্থাটির উপপরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যেরে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান দলের অন্য দুই সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নেয়ামুল হাসান গাজী ও শেখ মো. গোলাম মাওলা। অন্যদিকে ২০১৮ সালে ঢাকার বালু ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে ১৫ লাখ টাকার বালু কিনেছিলেন সাহেদ। সেই বালু পদ্মা সেতুতে ব্যবহার হবে বলে জানিয়েছিলেন জয়নালকে। দুই বছর হলেও বালুর টাকা পরিশোধ করেননি সাহেদ। জয়নাল আবেদিন বলেন, পাওনা টাকা চাইলে একদিন তিনি তাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখান। সিলেটের শামসুল মাওলা নামের এক ব্যবসায়ী দাবি করেন, তিনি সাহেদের কাছে ৩০ লাখ টাকা পাওনা। একবার টাকা চাইলে সাহেদ নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর পিএস (একান্ত সচিব)’ বলে হুমকি দিয়ে টাকা না দিয়ে চলে যায়। সাহেদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩টি মামলাও করেছেন শামসুল মাওলা। সাহেদের সঙ্গে ব্যবসা করে ১২ লাখ টাকা পাওনা আছেন এমন একজন ব্যবসায়ীর দাবি, ব্যবসার কাজে তিনি যখন তার কাছে যেতেন তখন নিজেকে ‘মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী’ দাবি করতেন সাহেদ। আবার কখনো ‘কর্নেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী’ও বলতেন। যখনই কথা হতো সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন তিনি। অনেকের কাছে দম্ভ করে চাপাবাজি করে বলতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করেন না! প্রসঙ্গত, ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৮ জনকে। এ ঘটনায় ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। এতে সোমবার রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে আটক ৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ৯ জনকে পলাতক আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবশেষ রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের প্রধান সহযোগী তারেক শিবলী এবং টিভি নাটকের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিহোম’র প্রধান ও সাহেদের ভায়রা মোহাম্মদ আলী বশিরকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ৫৬ মামলার আসামি সাহেদ পলাতক রয়েছেন। অনুসন্ধান করবে দুদক : দেশের ‘শীর্ষস্থানীয় জালিয়াত’ ৫৬টি প্রতারণা মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম চক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের বিশেষ তদন্ত অনুবিভাগ এবং দুদকের উপপরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম তদন্ত শুরু করেছে। গতকাল সোমবার কমিশন এই সিদ্ধান্ত নেয় বলে নিশ্চিত করেছেন দুদকের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। দুদক সূত্র জানায়, মাইক্রোক্রেডিট ও এমএলএম ব্যবসার নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাহেদ চক্রের বিরুদ্ধে। এছাড়া বহুমাত্রিক জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছে করোনা টেস্ট নিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করা সাহেদের বিরুদ্ধে। আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ও পরিচয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের বিষয়টি আমলে নিয়েছে দুদক। এর আগে কমিশনের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি, গণমাধ্যম, ভার্চুয়াল মাধ্যমসহ বিভিন্ন উৎস থেকে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সংগ্রহ করে। এসব তথ্য-উপাত্ত সংবলিত অভিযোগগুলো কমিশনের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল কমিশনে উপস্থাপন করলে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নেয়। রিজেন্ট হাসপাতালের মাধ্যমে করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ফাঁস হলে সাহেদ আত্মগোপনে চলে যান। তবে ধারণা করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতেই রয়েছেন তিনি। যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। জানা গেছে, আধা শিক্ষিত সাহেদ ১৯৯৯ সালের পর থেকেই প্রতারণা শুরু করেন। তার বাড়ি সাতক্ষীরায়। ওই এলাকার আরো একজন সাহেদ আছেন যার যাতায়াত সরকারের উচ্চপর্যায়ে। যেমনটি ছিল রিজেন্ট সাহেদের। বঙ্গভবন থেকে গণভবন। সর্বত্রই ছিল তার অবাধ বিচরণ। চতুর সাহেদ কৌশলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদকীয় উপকমিটির পদও বাগিয়ে নেন। আর সেই পদ বিক্রি করে তিনি রাতারাতি ঢাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন। অনুমোদন ছাড়া উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতালের মাধ্যমে করোনা রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। কম্পিউটার থেকে বের করে তিনি ইচ্ছে মতো পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট হাজার হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। তার প্রতিষ্ঠানের ভুয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে শত শত লোক প্রতারণার শিকার হন। বিদেশেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। এর আগে সাহেদ করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। গত রবিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে। এর পাশাপাশি তার নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় তথ্য সাত দিনের মধ্যে জানানোর জন্য সব তফসিলি ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App