×

সারাদেশ

দ্বিতীয় দফা ডুবছে উত্তর ও পূর্বাঞ্চল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২০, ১০:০৫ এএম

দ্বিতীয় দফা ডুবছে উত্তর ও পূর্বাঞ্চল

বন্যার পানিতে ডুবেছে বসতভিটা। হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের রৌমারির এক গৃহস্থ পরিবার ভোরের কাগজ

হু হু করে বাড়ছে বন্যার পানি। উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো দ্বিতীয় দফায় প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা, সুনামগঞ্জে সুরমা, গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা, জামালপুরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে তিস্তা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে যমুনা এবং মাদারীপুরে পদ্মার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এসব জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাওয়ায় ১০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রাস্তাঘাট নিমজ্জিত হয়ে জনচলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর সিলেট : সিলেটে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, ধলাই নদ-নদীর পানি। এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জসহ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল। ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ধান ও মাছের খামার। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে জানা যায়, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনকে। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুস সাকিব জানান, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আকস্মিক এ বন্যায় পানিবন্দি। তিনি বলেন, দীঘস্থায়ী বন্যার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে অর্ধশতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুরে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা নদী বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নগরীর বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের হাজার বিশেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গাইবান্ধা : গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ৩৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। এছাড়া তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানিও বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ৯ জুলাই থেকে আবারো পানি বাড়তে থাকে। ফলে ব্রহ্মপত্র, তিস্তা ও যমুনা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৫৫টি চরে নতুন করে দ্বিতীয় দফা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ২৬টি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার পরিবার। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া বাড়িঘর ছেড়ে গবাদি পশু নিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে। আকস্মিক বন্যার তীব্র স্রোতে গাইবান্ধা শহররক্ষা বাঁধসহ ফুলছড়ি ও সাঘাটায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। জামালপুর : যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরে আবারো বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল রবিবার দুপুরে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের। তবে বানভাসিদের দুর্ভোগ কমাতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জেলার ৭টি উপজেলা ও ৮টি পৌরসভা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ৪৯টি ইউনিয়নের ৩৫১টি গ্রাম। এতে ৯৩ হাজার ২২৫টি পরিবারের ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৬২৩ জন সরাসরি পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, উজানে বৃষ্টিপাত হওয়ায় আরো পানি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। গত ৩ দিন ধরে সুনামগঞ্জে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে উজানে অর্থাৎ ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় সুনামগঞ্জে আবারো বন্যা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের অনেক ঘর-বাড়িতে আবার পানি উঠেছে। শহরের নবীনগর, ষোলঘর, উকিলপাড়া, উত্তর আরপিননগরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সুরমা নদীর পানি কূল উপচে প্রবেশ করেছে। জেলার শিল্প শহর ছাতকসহ এই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত তিন দিনেই কাজিপুরের মেঘাই পয়েন্টে ফের বিপদসীমা স্পর্শ করেছে। তবে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে যমুনায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। ১০ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষজন। মাদারীপুর : হঠাৎ করে পদ্মা নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চরাঞ্চলের ৪টি ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মা নদীর চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত বন্দরখোলা, মাদবরেরচর, চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন বন্যায় তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমির আমন ও আউস ধান, পাট, বাদাম ও সবজি বিনষ্ট হয়েছে। অতিদ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেরিতে চাষ করা বাদাম ঘরে তুলতে পারেননি চাষিরা। লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তার বামতীরে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে চরাঞ্চল ও তীরবর্তী গ্রামের ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, তিস্তা নদীতে গভীরতা না ধাকায় সামান্যতেই এ জেলায় বন্যা দেখা দেয়। তাই নদী খনন করে দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাব ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। একনেকে অনুমোদন হলেই লালমনিরহাটবাসী বন্যা থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাবে। এছাড়াও চলমান বন্যায় পানিবন্দি পরিবারগুলোর খোঁজ-খবর নিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত মানুষ ঘরে ফিরতে না ফিরতেই আবারো বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা নদের পানি প্রবাহিত হওয়ায় ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গত এক সপ্তাহ আগে হয়ে যাওয়া বন্যায় খাদ্যের মজুত ও সঞ্চিত টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজন। কাউনের চাল, চীনা ও চরে উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়াই এখন বানভাসি অভুক্ত মানুষের বাঁচার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। সঙ্গে আছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। এদিকে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, তার এলাকায় বন্যাকবলিত মানুষজন খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকটে রয়েছেন। গত দুই দিনে তার এলাকার বালাডোবা, সরকারপাড়া, খুদিরকুঠি, শেখ পালানু মৌজা, মশালের চর ও আমিনবাজার এলকার ৫৭টি বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। ডিমলা (নীলফামারী) : নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তিস্তার পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা ও ভাঙনের কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনপ্রনিধিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৭ হাজার পরিবারের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। শেরপুর (বগুড়া) : বগুড়া জেলায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যমুনা নদীতে পানি গত ২৪ ঘণ্টা ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। রবিবার দুপুরে যমুনা নদীর পানি সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া বাড়ছে বাঙ্গালী নদীর পানিও। ফলে জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App