×

জাতীয়

মূলোৎপাটন না হওয়ায় সুযোগ খুঁজছে জঙ্গিরা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২০, ১২:৪৮ পিএম

দেশে বিভিন্ন সময় একাধিক জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তবে তারা নির্মূল হয়নি। তারা নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে, নাশকতার পরিকল্পনা ও ছক আঁকছে। বিদেশেও তাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা সব সময় সতর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। সূত্র জানায়, যেসব দিবসে লোক জমায়েতের সম্ভাবনা রয়েছে সেসব দিবসকে টার্গেট করে জঙ্গিরা নাশকতার পরিকল্পনা করে। তাদের অধিকাংশ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তা ভেস্তে গেছে। এরপরও তারা বসে নেই। নতুন সুযোগ খুঁজছে। সামনে ঈদ জামাতে তারা হামলা করতে পারে বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। ৪ বছর আগে শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলা করে সারা দুনিয়ায় যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, ফের এমন কিছু করতে চায় তারা। গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তথ্যমতে, পুরনো জেএমবির প্রধান হিসেবে ভারতে থেকে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন সালাহউদ্দীন সালেহীন। আর দেশে আত্মগোপনে থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর (অব.) সৈয়দ জিয়াউর রহমান। এছাড়া হলি আর্টিজান মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক ২ আসামি মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল খালিদ বর্তমানে ভারতে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় আছে। শরিফুল খালিদ ও রিপন নব্য জেএমবি ছেড়ে পুরনো জেএমবিতে ভিড়ছে বলেও তথ্য রয়েছে সিটিটিসির কাছে। পুলিশ, র‌্যাব ও সিটিটিসির তথ্যমতে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পুরনো জেএমবির কিছু সদস্য ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পলাতক সদস্যরা একই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে। হামলা পরবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপনের জন্যই তারা একে অপরের জন্য ‘সেফহোম’ তৈরির উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে একাধিক বৈঠক করেছে। এছাড়া ‘সালাফি’ মতবাদী জঙ্গিরা সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়ে ভারতে অবস্থিত জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের জঙ্গিরা কৌশল পরিবর্তন করে অনলাইনেও তৎপর রয়েছে। এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট তানভীর হাসান জোহা বলেন, তারা এখন অ্যাক্রিপ্টেড টেলিগ্রাম, ডার্কওয়েব ব্যবহার করছে। তাদের কিছু নিজস্ব অ্যাপসও আছে। এসবের মাধ্যমে তারা তাদের যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি সমর্থক বাড়াচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণভাবে চিহ্নিত করতে পারছে না। আর ১৫-৩০ বছরের বাংলাদেশি নাগরিকরা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে। তারা সবচেয়ে বেশি তৎপর চট্টগ্রাম ও সিলেটে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযান নতুনমাত্রা পায়। ওই ঘটনার পর অন্তত ২০টি বড় আকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরপরও জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন হয়নি। হলি আর্টিজান জঙ্গিমুক্ত করতে ওই সময় পরিচালিত হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’। ওই মাসেই ঢাকার কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলের জঙ্গি আস্তানায় ২৬ জুলাই ‘অপারেশন স্ট্রং-২৬’ নামে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট সিটিটিসি ও পুলিশ সদর দপ্তর যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় চালায় অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭। এতে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীসহ ৩ জঙ্গি নিহত হয়। এরপর সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ আরো ২০টি বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে ৭ শিশুসহ মোট ৭৭ জন নিহত হয়। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় ১০ জঙ্গি। হলি আর্টিজানে হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুনরূপ নব্য জেএমবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। জেএমবি ২০০৬ সালে সারাদেশের ৬১ জেলায় একযোগে বোমা হামলাসহ আরো অনেক জঙ্গি হামলার ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। হলি আর্টিজান হামলা থেকেই বাংলাদেশে জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর এই আত্মঘাতী হামলা হয়েছে ঢাকার এয়ারপোর্ট রোড এলাকার পুলিশ বক্সে, আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন স্থাপনায়, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহলে গত বছর সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ পরিচালনা করেন। এতে এক নারীসহ ৪ জঙ্গি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয়। অভিযান চলাকালে জঙ্গিদের হামলায় একজন র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। এসব জঙ্গি আস্তানা থেকে সুইসাইড ভেস্টসহ বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। হলি আর্টিজানের পরও বাংলাদেশে লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও ভিন্ন চিন্তার মানুষের ওপর জঙ্গিদের পরিকল্পিত হামলা ও হত্যা বন্ধ হয়নি। এসব হামলা ও হত্যায় জেএমবি ছাড়াও এবিটি জড়িত। দেশে ধারাবাহিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আটক ২ হাজারেরও বেশি জঙ্গি সদস্য এখন কারাগারে রয়েছে। আর হলি আর্টিজান হামলার মাস্টারামাইন্ড নব্য জেএমবির তামিম চৌধুরীসহ আরো অনেক শীর্ষ জঙ্গি অভিযানে নিহত হওয়ার পরও বাংলাদেশ এখনো বড় ধরনের জঙ্গি ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান বলেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আমরা জঙ্গিদের সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। ফলে হলি আর্টিজানের পর তারা বড় ধরনের কোনো অপারেশন চালাতে পারেনি। তবে তাদের তৎপরতা কমেনি। তারা অভ্যন্তরীণভাবে সক্রিয় রয়েছে। এর বড় প্রমাণ, পুলিশ প্রায়ই বিভিন্ন জেলায় জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সামরিক সমাধান হয়েছে। জঙ্গি তৈরি হয়েছে এবং তাদের গুলি করে নির্মূলের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে নিরাপত্তাহীনতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের কারণ ধরে তা দূর করার চেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের প্রয়োজন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করা। এজন্য সবার আগে আমাদের শিক্ষায় এটা নিয়ে পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। কোনো ধরনের শিক্ষা বা ‘আদর্শ’ যদি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে তবে তা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নির্মূল হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App