×

জাতীয়

কাজ হারানোর ঝুঁকিতে লাখ লাখ প্রবাসী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২০, ১১:১০ এএম

কাজ হারানোর ঝুঁকিতে লাখ লাখ প্রবাসী
অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি সুখে নেই, ভালো নেই। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনার আগে যারা দেশে এসেছেন তারা পড়েছেন বিপাকে। ভিসা থাকতেও ঢুকতে পারছেন না তারা ইতালি, জাপান, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে। অনেক দেশের বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশিদের। কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সময় কাটছে উদ্বেগের মধ্যে। কাজ না থাকায় কয়েক লাখ প্রবাসীকে ছাড়তে হবে প্রবাসজীবন। ফিরতে হবে দেশে। এ অবস্থায় চরম অনিশ্চতায় দিন কাটছে কয়েক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির। এ প্রসঙ্গে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শামসুল আলম গতকাল শনিবার ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা প্রতারিত হচ্ছেন। তাদের কারণে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তবে ওই এজেন্সিগুলোর ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। যেসব দেশ থেকে লোক ফেরত আসছে, অনেকের ভিসার মেয়াদ হয়েছে। অসুস্থতার কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় আসছেন। এটা আগেও ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন শ্রমবাজারের জন্য সরকার চেষ্টা করছে। বেশকিছু দেশে সাড়াও মিলেছে। ইতালির ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিমানবন্দর ও ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। প্রাপ্ত তথ্য মতে, অনলাইনে ক্লাস হলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হবে সেদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। নতুন আবেদনকারীদেরও কোনো ভিসা দেয়া হবে না। ৬ জুলাই সোমবার মার্কিন ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানালেও অনলাইনে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা। এতে বিড়ম্বনায় পড়তে যাচ্ছে কয়েক হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সাত হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। ইউরোপের পর করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির নিউইয়র্ক শহরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি, যেখানে বসবাস করেন বহু বাংলাদেশি। যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কয়েকশ বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অধিকাংশ প্রবাসী নিম্নআয়ের হওয়ায় লকডাউনের কারণে তারা বিপাকে পড়েছেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি আর্থিক ঝুঁঁকির মুখেও পড়েছেন তারা। ফ্রান্স থেকে কয়েক দফায় সম্পূর্ণভাবে লকডাউন তুলে দেয়া হলেও, এখনো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেনি ফ্রান্স প্রবাসী বাংলাদেশিরা। লকডাউনে রেস্টুরেন্ট, বারসহ বড় মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায় অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমানে রেস্টুরেন্টগুলো খুলে দেয়ার পর কিছুসংখ্যক প্রবাসী কাজে যোগদান করতে পারলেও চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। ইতালিতে আইন শিথিল না হলে অধিকাংশ বাংলাদেশি এবারো অবৈধ থেকে যাবেন। দেশটিতে প্রায় ২০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন। বৈধতার আবেদন পড়ার হার কম হওয়ায় সরকার আরো একমাস সময়সীমা বাড়িয়েছে। সেখানে ছয় লাখ অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে সরকার দুই লাখ ২০ হাজার অভিবাসীকে বৈধতা দেয়ার কথা জানালেও সে তুলনায় আবেদন পড়েনি। গত ১৫ দিনে জমা পড়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৯৫০টি আবেদন। কৃষিক্ষেত্রে এ হার মাত্র পাঁচ ভাগ। কঠিন আইনের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবারো বৈধতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার ইতালির সব শহরে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ৬০০ বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারণা করছেন দেশটির লাজিও অঞ্চলের স্বাস্থ্য কাউন্সিলর আলেসিয়ো ডি’আমাটো। রোমের দৈনিক পত্রিকা ইল মেসাজেরোকে তিনি এ কথা বলেছেন। ডি’আমাটো ওই পত্রিকায় জানিয়েছেন, আক্রান্ত ওই বাংলাদেশিরা সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে এসেছেন। আলেসিয়ো ডি’আমাটো জানান, প্রায় দুই হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি ইতালিতে ফিরে গিয়েছেন। প্রথম দিকে সেভাবে পরীক্ষা না হলেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত বাংলাদেশির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় তারা এয়ারপোর্টে পরীক্ষা শুরু করেন। আর এতেই এমন ভয়াবহ তথ্য বের হয়ে আসে। তাদের ব্যাপারে ইতালি সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ১২৫ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার জানিয়েছেন, ইতালি সরকার সাত দিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে আসা সব ফ্লাইট বাতিল করেছেন। অন্যদিকে কুয়েতে মানবপাচার ও ঘুষ কেলেঙ্কারির জেরে কারাবন্দি বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের কারণে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক বিপাকে পড়েছেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেদেশের সরকার। এরইমধ্যে অবৈধভাবে বসবাসের কারণে সাত হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে কুয়েত থেকে। নিঃস্ব হয়ে দেশেফেরা এমন মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এদিকে, কুয়েত সরকার তার দেশ থেকে অভিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে একটি প্রবাসী কোটা বিল প্রণয়ন করেছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। ওই খসড়া আইনে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য মাত্র তিন শতাংশ কোটা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আইনটি পাস হলে দেশটিতে অবস্থানরত আড়াই লাখের বেশি অভিবাসীকে ফেরত আসতে হতে পারে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। জাপানে লেখাপড়া করতে আসা প্রচুর সংখ্যক বিদেশি ছাত্রকেও ভিন্ন এক দিক থেকে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করতে আসা শিক্ষার্থীদের বৃত্তি সাধারণত শিক্ষার পাট চুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় এবং এদের মধ্যে বড় এক অংশ মার্চ মাসের শেষ দিকে জাপান ত্যাগ করে। করোনার কারণে এদের পক্ষে দেশে ফেরাও সম্ভব হচ্ছে না। আর যারা বৃত্তির অর্থে লেখাপড়া না করে দোকান, রেস্তোরাঁ কিংবা অন্যান্য জায়গায় কাজ করে লেখাপড়ার অর্থ জোগাড় করে পাঠ শেষ করেছে, সেরকম শিক্ষার্থীদের সমস্যা আরো অনেক বেশি জটিল। জাপান সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২৮ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি দেয়। তবে সেই অনুমতির একটি শর্ত হচ্ছে, এদের কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে হবে। ছাত্র জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর কাজের সুযোগ এদের জন্য খোলা থাকে না। ফলে মার্চ মাসে যারা শিক্ষা শেষ করেছে, তারা না পারছে দেশে ফিরতে, না পারছে কাজ করা অব্যাহত রেখে জাপানে বসবাসের খরচ মেটানোর মতো উপার্জনের ব্যবস্থা করে নিতে। জাপানে প্রচুর বিদেশি খণ্ডকালীন কাজের পয়সায় জাপানি ভাষা শিক্ষার স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। মার্চ মাসে শিক্ষা শেষ করা সে রকম বড় একটি দল দেশে ফিরে যেতে পারছে না। অন্যদিকে কাজ করার অনুমতি না থাকায় বিপদ আরো বেড়েছে। আর যারা অনুমতি ছাড়া সামান্য মজুরিতে ক্যাফে, বার, রেস্তোরাঁ ও খুচরা বিক্রির ছোট অনেক দোকানে কাজ করত; ক্রেতার অভাবে সেগুলো বন্ধ হওয়ার অবস্থা। এদের অনেকে দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়ার আগে পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্যের জন্য জাপান সরকারের কাছে আবেদন জানালেও এখনো সাড়া মেলেনি। নিজ নিজ দেশের দূতাবাস অবশ্য চেষ্টা করছে দ্রুত এদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে। বিপাকে আছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। সৌদি আরবে থাকা ২০ লাখ বাংলাদেশির অধিকাংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকের আকামা (কাজের বৈধতা) শেষ হয়েছে। অবৈধ হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। গত কয়েক মাসে দেশে ফিরেছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। এ অবস্থায় ১০ লাখের বেশি সৌদি প্রবাসী অনিশ্চতার মধ্যে দেশে ফিরতে পারেন বলে জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোতে খবর রয়েছে। মালয়েশিয়ার খবরও সুখকর নয়। সেখানে অবৈধভাবে থাকায় কয়েকশ বাংলাদেশি কারাবন্দি রয়েছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। যুক্তরাজ্যে যেসব শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন তারা দেশে ফিরলেও আবার কবে যাওয়ার ডাক পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। দীর্ঘ অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে পর্তুগাল, স্পেনসহ গোটা ইউরোপ। কর্মস্থলে ফিরতে চান বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা। করোনা মহামারির আগে ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে ফিরে বিপাকে পড়েছেন কয়েকশ পর্তুগাল প্রবাসী। দ্রুতই তারা পর্তুগালে ফিরতে ছুটছেন বিভিন্ন এজেন্সিতে। নিরূপায় এসব প্রবাসী সরকারের সহযোগিতা চেয়েও সাড়া পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। হেমায়েত হোসেন নামে আটকা পড়া এক বাংলাদেশি বলেন, ছুটি কাটাতে এসে আটকা পড়ছি। এখন ফেরাটা জরুরি। ইমরান আহমেদ নামে আরেক বাংলাদেশি বলেন, আমরা জব রেখে এসেছি, বাচ্চার স্কুল আছে। গাড়ি-বাড়ি সব রেখে এসেছি। আরেকজন বলেন, আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন আছে আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট না থাকার কারণে যেতে পারছি না। অবশ্য এমন পরিস্থিতিতে আগ্রহী যাত্রীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে জানিয়ে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পর্তুগালে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত রুহুল আলম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, কারো পাসপোর্টের ভ্যালিডিটি কমে এসেছে, কারোটা শেষ হয়ে গেছে। অনেকের পর্তুগালে রেসিডেন্ট কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাদের বিষয়েও পর্তুগাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, যাতে তাদের প্রবেশে কোনো অসুবিধা না হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App