×

সাহিত্য

লুটপাট-প্রতারণা মানসিক কষ্টের কারণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২০, ১১:৫২ পিএম

লুটপাট-প্রতারণা মানসিক কষ্টের কারণ

মুনতাসির মামুন

লুটপাট-প্রতারণা মানসিক কষ্টের কারণ

মুনতাসির মামুন

লুটপাট-প্রতারণা মানসিক কষ্টের কারণ

মুনতাসির মামুন

বিশেষ সাক্ষাৎকার মুনতাসীর মামুন ইতিহাসবিদ ও লেখক

মুনতাসীর মামুন। বরেণ্য ইতিহাসবিদ ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’। গল্প, কিশোর সাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, চিত্র সমালোচনা, অনুবাদসহ সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রয়েছে তার। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন লড়াকু এবং আপসহীন এক মানুষ তিনি। সম্প্রতি করোনা জয় করে ফিরে এসেছেন তিনি। বরেণ্য এই ইতিহাসবিদের করোনাকাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা থেকে সুস্থ হয়ে আসার পর হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। সেটাও কাটিয়ে উঠেছি। এখন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি। অন্যদের দেখছি করোনার পরে দুই তিন সপ্তাহ ধরে শুয়ে থাকছেন। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। চার পাঁচ দিন পরেই একেবারে আমার আগের যে রুটিন, সে রুটিনেই কাজ করছি। তবে, করোনাকালটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার জন্য বিপর্যস্তকর। আমার মা অসুস্থ ছিলেন, আমি অসুস্থ হয়েছি। আমরা সেরে উঠেছি।

এই আমি যে সুস্থ শরীরে লিখতে পারছি বেঁচে আছি তার বড় অবদান আমাদের প্রধান মন্ত্রীর। তিনি ঠিক সময়ে আমার সুচিকিৎসার কথা বলেছেন এবং আমাকে সিএমএইচে ডাক্তাররাও সুচিকিৎসা দিয়েছেন। এজন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন মারা যাচ্ছেন। প্রত্যেকদিন আমি খবরের কাগজ খুলেই দেখি আমার ঘনিষ্ট কোনো না কোনো একজন মারা গেছেন। আমার পঞ্চান্ন বছরের বন্ধু সুবর্ণ প্রকাশনীর আহম্মেদ মাসুদুল হক মারা গেছেন। দুদিন আগেও তার সঙ্গে কথা বলেছি যে, করোনাকালে পাবলিকেশনের কী হবে না হবে এসব নিয়ে। এরকম প্রতিদিনই কেউ না কেউ চলে যাচ্ছে। ফলে একদিক থেকে আমরা একা হয়ে যাচ্ছি। একা হয়ে যাচ্ছি এ কারণে, আমাদের সমসাময়িক যারা তারা চলে যাচ্ছে।

আমাদের জায়গাগুলি খালি হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আমাদের আগের জেনারেশনের যারা আছেন তারাও তো নিয়মিতভাবে চলে যাচ্ছেন। আমি যদি করোনাকালে চলে যাওয়া বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের কথাই ধরি, তার চলে যাওয়া তো আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, জাতীয় ক্ষতি। এরপর আনিসুজ্জামান থেকে শুরু করে সব তো চলে যাচ্ছেন। আমাদের আগের জেনারেশন যাচ্ছে, আমাদের জেনারেশন যাচ্ছে। এই ক্ষতি কখন যে পূরণ হবে আমি জানি না।

এ ছাড়া পেশাদারি ক্ষেত্রে ডাক্তারদের যেরকম ক্ষতি হচ্ছে। ডাক্তাদের ক্ষেত্রে ডিগ্রির চেয়ে অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা। পঁয়ষট্টি থেকে পঁচাত্তর বয়সের প্রচুর ডাক্তার মারা যাচ্ছেন। কেন আমি জানি না বাংলাদেশে ডাক্তারদের মরার রেস পৃথিবীতে দীর্ঘ। এসব হারানো মানসিক চাপ সৃষ্টি করছেই। দ্বিতীয়ত, আত্মীয়-স্বজনও মারা গেছেন অনেকে। এ ছাড়া এর মধ্যে চারিদিকে যে লুটপাট দেখছি, প্রতারণা দেখছি, এটাও মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ আমরা আজীবন এসবের বিরুদ্ধেই বলে আসছি। শেখ হাসিনার সময় এরকমটা হচ্ছে। উনি ধরছেন, ঠিক আছে। কিন্তু তাদের কারো কোনো শাস্তি হচ্ছে না। যারা প্রশাসনে আছে তাদের বদলি করা হচ্ছে। আর যারা আছে তাদের দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই জিজ্ঞাবাদ তো অনন্তকাল চলবে।

তার ওপর দেখা যাচ্ছে এদের প্রত্যেকেরই কারো না কারো গডফাদার আছে। ফলে সব মিলিয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটা বিপর্যকর পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যক্তিগতভাবে এক্ষেত্রে আমার করণীয় কিছু নেই। কোভিডের জন্য তো আমি এখন আর স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারবো না। এমনিতেই আমি অবসরে আছি। আমি একজন লেখক এবং গবেষক, রুটিন মেনে আমি সেই কাজই করছি। হয়তো কোনো কাজ পাঁচ বছর আগে শুরু করেছিলাম, অর্ধেক আছে সেটার কাজ করছি। কোনোটার প্রুফ দুবছর ধরে পড়ে আছে, এমন অসমাপ্ত কাজগুলো করছি। বিশেষ করে ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনী’র তৃতীয় খণ্ডটা ইতোমধ্যে শেষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথমা একটা বইও প্রকাশ করেছে কদিন আগে। কথাপ্রকাশও প্রকাশ করেছে ‘ইতিহাস পাঠ’এর চতুর্থ খণ্ড।

[caption id="attachment_231190" align="aligncenter" width="700"] মুনতাসির মামুন[/caption]

আমি আমার রুটিন মেনেই এসব কাজ করে যাচ্ছি। কারণ মনে করি করোনাকাল তো শেষ হবে একদিন। অনন্তকাল তো চলবে না। এর মধ্যেও একজন লেখক হিসেবে আমাকে লিখতেই হবে। আমি তাই করছি। সবাই যদি যার যার কাজটা করেই যায়, তাহলে তো এগিয়ে যাবে। আমি সবসময় মনে করেছি, দেশ সেবার কাজটা আমি আমার লেখার মাধ্যমেই করছি। এ ছাড়া আমার সঙ্গে যারা বিভিন্ন গবেষণার কাজ এবং একাডেমিক পর্যায়ের কাজ করছে। ওদের টেলিফোনে পরামর্শ উপদেশ এসব দিচ্ছি। রুটিন করে পড়াশোনা আর লেখালেখির কাজ করছি।

কী পড়ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার তো গবেষণার কাজে নানারকম বই পড়তে হয়। যেমন বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখতে গিয়ে আমার তেরটা বই পড়তে হয়েছে। গবেষণার কাজে নির্দিষ্ট কোনো বই নেই। যখন যে বিষয় নিয়ে কাজ করি বই পড়ি। সকালে এক টেবিলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাজ করলাম, বিকেলে ঢাকার ওপরে করলাম, রাতে হয়তো পূর্ববঙ্গের ওপর করলাম। তিন টেবিলে তিনটা কাজ করি। তিন টেবিলে তিন রকমের বই তিন রকমেরই কাজ। মোট কথা আমি মনে করছি আমাদের আয়ু কমে আসছে। যতটুকু আয়ু আছে আমার লেখালেখির কাজটা আমি করে যাচ্ছি। যদি সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায় কিম্বা আবার যদি ফিরে আসে হয়তো কাজে লাগবে। মনের আনন্দের জন্য ওভাবে কোনো বই পড়ছি না। মূলত আমি গবেষণার বই পড়েই আনন্দ পাই।

করোনার এই সময়টায় চেনা পৃথিবীর কতোটা বদল ঘটেছে জানতে চাইলে করোনাজয়ী এই শিক্ষাবিদ বলেন, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। তবে যেটা লক্ষ্য করছি তা হচ্ছে- অমানবিকতা। উনিশ-বিশ শতকে মহামারি হয়েছে। কিন্তু তখন মানুষ সেবা দিয়েছে। মারাও গেছে পালিয়েও গেছে, লোকজন বন্ধু বান্ধবের সেবাও করেছে। আমাদের এখান থেকে সম্পূর্ণভাবে এই বিষয়টা চলে গেছে। যেটা আমার কাছে খুব পীড়াদায়ক মনে হচ্ছে। আমি যদি আমার ছেলেকে দেখতে না যাই, সে যদি আমায় দেখতে না আসে তাহলে তো মানুষের জীবনের কোনো লাভ নেই।

[caption id="attachment_231336" align="aligncenter" width="700"] মুনতাসির মামুন[/caption]

আমার কাছে আরেকটা বিষয় কষ্টদায়ক মনে হচ্ছে- অনেককে দেখছি দুই পাতার ইংরেজি পড়া লোকজন কিছু জিনিস চাপিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পড়াশোনা করা। আমাদের ঢাকাতেই যেখানে নেট সমস্যা হচ্ছে, সেখানে যে ছেলেটি ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে তার কী হবে? যারা বড় বড় কথা বলছে তারা কি জানেন গ্রামে বিদ্যুৎ থাকে না? বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। কিন্তু থানা লেভেল পর্যন্ত সবসময় বিদ্যুৎ থাকে না। তাদের বিদ্যুৎ খরচও এখন বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তার মধ্যে কারো ক্লাস ৫টায়, কারোটা ৭টায়। এভাবে কি পড়াশোনা হবে?

প্রণোদনা প্রশ্নে এই লেখক আরো বলেন, কেবল গার্মেন্টস শিল্পকে প্রণোদনা দিলে হবে না। প্রকাশনা শিল্প থেকে শুরু করে অন্যান্য সেক্টরেও প্রণোদনা দিতে হবে। প্রকাশনার শিল্পের কথা এই অর্থে বলা, শিল্প সংস্কৃতির এইসব মানুষ সবসময়ই সরকারের পাশে থাকেন রাজপথ থেকে সর্বত্রই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App