×

পুরনো খবর

পলিটেকনিক শিক্ষায় বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রসঙ্গে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২০, ০৮:৫০ পিএম

পলিটেকনিক শিক্ষায় বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রসঙ্গে

একুশ শতকের দক্ষতা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং ৫ম সামাজিক বিপ্লব বিবেচনায় বিদ্যমান ডিপ্লোমা কোর্সগুলোর বাজার চাহিদা নিরূপণ ও নতুন ইমার্জিন কোর্স চালুর জন্য অবিলম্বে জব মার্কেট সার্ভে শুরু করত কারিকুলামে বড় ধরনের পরিবর্তন আনয়ন প্রয়োজন।

কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির নীতিমালা প্রণয়নে বা নীতি ঠিক করার আগে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক ও অংশীজনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপট, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য, শিক্ষা কাঠামো ও প্রশিক্ষণ কাঠামোর পৃথক বৈশিষ্ট্য এবং পৃথক বাস্তবায়ন কৌশল এবং অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি অনুধাবন করা প্রয়োজন। Education I Training-এর দুটি আলাদা দর্শন আছে। এই দুটি ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ভিন্ন, আয়োজন ভিন্ন, পাঠদান পদ্ধতি ভিন্ন, অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি ভিন্ন, পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও কৌশলও ভিন্ন। আমরা সবাই জানি পলিটেকনিকের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম একটি একাডেমিক কোর্স, প্রশিক্ষণ কোর্স নয়। সুতরাং পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যারা পড়ে তারা শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী নয়। কাজেই পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে কোমলমতি সদ্য এসএসসি পাস ভর্তিচ্ছুকদের সঙ্গে যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থী ভর্তি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বয়স্কদের জন্য বা বিশেষ শ্রেণি/গোষ্ঠীর প্রয়োজনে পলিটেকনিকে স্বল্পমেয়াদি স্ব-অর্থায়নে বা প্রজেক্টের আওতায় পৃথক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে আসছে বহু বছর আগ থেকে। এখনো বিভিন্ন পলিটেকনিকে সান্ধ্যকালীন ট্রেড কোর্স ও এনটিভিকিউএফ চলমান আছে। কিন্তু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দুই ধারাকে কখনোই একই প্রোগ্রামের মধ্যে একই কোর্সে একত্রিত করা হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কারো যদি দীর্ঘ ব্রেক অব স্টাডি থাকে এবং পরে সে কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিতে চায় তবে তার জন্য কি কোনো পথ খোলা রাখা হবে না। আমি বলব অবশ্যই তা খোলা রাখা উচিত।

কর্মরত বা বেকার কোনো বয়স্ক বা বিদেশ ফেরত কেউ যদি প্রশিক্ষণে দক্ষতা অর্জন করতে চায় তবে তাদের জন্য আমরা কী করতে পারি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর আলোকে জাতীয় কারিগরি বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামোর (এনটিভিকিউএফ) আওতায় ১৮৬টি অকুপেশনে দেশব্যাপী ৪ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে এনটিভিকিউএফ লেভেল ১ থেকে ৬ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ আছে। সরকার প্রয়োজনে আরো প্রতিষ্ঠান চালু করতে পারে এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। যারা কাজ করতে করতে ইতোমধ্যে দক্ষতা অর্জন করেছেন কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বা যোগ্যতা সনদ বা স্বীকৃতি নেই তারা সহজেই পূর্ব যোগ্যতার স্বীকৃতি (RPL) সনদের জন্য এনটিভিকিউএফের আওতায় রেজিস্টার্ড ট্রেনিং অরগানাইজেশনে (RTO) গিয়ে যোগ্যতা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সনদ অর্জন করতে পারেন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদায়িত রেজিস্টার্ড অ্যাসেসর কর্তৃক এ অ্যাসেসমেন্ট সম্পন্ন করে এদের সনদ প্রদান তথা পূর্ব যোগ্যতার স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। এই সনদের মাধ্যমে দেশে শ্রেণিবিন্যস্ত জনবল তৈরি করে জাতীয় দক্ষতা তথ্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা যায়। বয়স্ক কিংবা বিদেশ ফেরতদের পলিটেকনিকে ৪ বছর মেয়াদি একাডেমিক কোর্সে ভর্তি হওয়ার কোনো চাহিদা বা আগ্রহ আমার গোচরে আসেনি এবং এর কোনো সম্ভাব্যতাও আমরা দেখতে পাইনি।

পলিটেকনিকে প্রতি বছর কেন হাজার হাজার সিট খালি থাকে। বয়স্ক লোক ভর্তি করে সেই সিট কি আদৌ পূরণ করা সম্ভব। ভেতরের বিষয়টি জানলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রতি বছর সরকারি পলিটেকনিকে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার আসন খালি থাকে। এর জন্য অনেক কারণ চিহ্নিত করা যায়। এর মধ্যে অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে- পলিটেকনিকে ইমার্জিন টেকনোলজি নামে এমন কতগুলো টেকনোলজি খোলা হয়েছে যাদের এ দেশের চাকরি বাজারে কোনো চাহিদা নেই। আবার চাহিদা থাকলেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এই টেকনোলজির নাম না থাকায় এরা সব টেকনোলজিতে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি বা কর্মসংস্থানের কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বা যোগ্যতা প্রমাণের সুয়োগ নেই। উদাহরণস্বরূপ চাকরি বাজারে ইনস্ট্রমেনটেশন এন্ড প্রসেস কন্ট্রোল টেকনোলজির কোনো চাহিদা না থাকায় ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকে এ টেকনোলজিতে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চায় না বা ভর্তি হলেও কিছুদিন পর ইতোপূর্বে উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটদের বেকারত্বের তথ্য পাওয়ার পর আর ওই টেকনোলজিতে পড়ালেখা অব্যাহত রাখে না বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার কম্পিউটার টেকনোলজির চাহিদা থাকলেও সরকারের কোনো দপ্তরে এমনকি খোদ আইসিটি অধিদপ্তর, কম্পিউটার কাউন্সিল এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কোথাও এদের জন্য কোনো পদ সৃজন করা হয়নি। সরকারি দপ্তরে এদের কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই। এনভায়রনমেন্টাল টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের পরিবেশ অধিদপ্তরে নেই কোনো স্থান। সরকারি-বেসরকারি সব স্তরে মেকাট্রনিক্স টেকনোলেজির লোক দরকার হলেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শুধু মেকানিক্যাল টেকনোলজির কথা উল্লেখ থাকায় মেকাট্রনিক্সে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা দরখাস্ত করারই সুযোগ পান না। এসব টেকনোলজিতে নেই উপযুক্ত শিক্ষক, কোনো কোনো টেকনোলজিতে একজন শিক্ষকও নেই। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুযায়ী সরকারি পলিটেকনিকে শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত ১২:১ থাকার কথা। সরকারি পলিটেকনিকে বিদ্যমান শিক্ষার্থীর এনরোলমেন্ট কম-বেশি ৫০ হাজার জন প্রতি বছর  ৪ বছর=২ লাখ আসনের বিপরীতে শিক্ষক পদ থাকার কথা ১৬ হাজার ৬৬৬টি, বাস্তবে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলে প্রকৃত পদ আছে ১ হাজার ৭৮৪টি, অর্থাৎ পদের সংখ্যা প্রয়োজনীয়তার ১০.৭ শতাংশ। এর মধ্যে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন ১ হাজার ২৯ জন বা ৫৮ শতাংশ, খালি পদের সংখ্যা ৭৫৫টি, যা বিদ্যমান পদের ৪২ শতাংশ। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক বস্তুত নেই বললেই চলে। টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজটি একটি অচল প্রতিষ্ঠান। এমতাবস্থায় ভর্তি সংক্রান্ত নীতিমালার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনসহ নিম্নবর্ণিত করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে-

১। ভর্তির ইতোপূর্বে গৃহীত ২০১৯-এর নীতিমালা বহাল রাখা এবং বোর্ড সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে নীতিমালা চূড়ান্ত করা।

২। বয়স্ক বা বিদেশ ফেরত কর্মীদের জাতীয় কারিগরি বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো এনটিভিকিউএফের আওতায় দেশব্যাপী ৪ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে লেভেল ১ থেকে ৬ পর্যন্ত ১৮৬টি অকুপেশনে প্রশিক্ষণ প্রদান করার ব্যবস্থা। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিবহির্ভূত মানহীন সব স্বল্পমেয়াদি কোর্স বন্ধ করা।

৩। পলিটেকনিকগুলোতে ইমার্জিন টেকনোলজি নামের যেসব টেকনোলজির আসন খালি থাকে সেগুলোকে মূল প্রচলিত ও বহুল পরিচিত টেকনোলজি যেগুলোর সচরাচর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয় যেমন- সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, কাম্পউটার, আর্কিটেকচার, কেমিক্যাল ও ফুড, অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেশন এন্ড এয়ারকন্ডিশনিং টেকনোলজির সঙ্গে একীভূত করে ৬ষ্ঠ পর্ব থেকে ইমার্জিন স্পেশালাইজেশন চালু করার ব্যবস্থা করা। এর ফলে একজন ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্র্যাজুয়েট যে স্পেশালাইজেশন থেকে উত্তীর্ণ হবে সে তার মাদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আওতায় সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাবে। ফলে সব টেকনোলজিতেই শিক্ষার্থী ভর্তি হবে। আসন খালি থাকার সম্ভাবনা কমে যাবে।

৪। একুশ শতকের দক্ষতা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং ৫ম সামাজিক বিপ্লব বিবেচনায় বিদ্যমান ডিপ্লোমা কোর্সগুলোর বাজার চাহিদা নিরূপণ ও নতুন ইমার্জিন কোর্স চালুর জন্য অবিলম্বে জব মার্কেট সার্ভে শুরু করত কারিকুলামে বড় ধরনের পরিবর্তন আনয়ন প্রয়োজন।

৫। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি ও সামাজিক আচার থেকে বেরিয়ে এসে আনুষ্ঠানিক সুশৃঙ্খল, দক্ষ উৎপাদনশীল জাতিতে রূপান্তরের জন্য এবং আত্মকর্মসংস্থানকে বেগবান করার জন্য কারিকুলামে টেকনোপ্রেনিয়ারশিপ কোর্স জোরদার ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

এ কে এম এ হামিদ : সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App