×

জাতীয়

খাওনের পয়সা নাই, মুখোশ পামু কই

Icon

nakib

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২০, ০৯:৫৪ এএম

খাওনের পয়সা নাই, মুখোশ পামু কই

অল্প আয়ের মানুষের অপেক্ষা

খাওনের পয়সা নাই, মুখোশ পামু কই

ফুটপাথে জীবন

খাওনের পয়সা নাই, মুখোশ পামু কই

করোনাকালে ফুটপাথের জীবন

‘মা গো খাওনের পয়সা নাই মুখোশ (মাস্ক) কই পামু- খিদায় প্যাডের ভিত্যরে ডাক পারে’ বলতে গিয়েই চোখের পানি গড়িয়ে মাটিতে পড়ছিল রমনা এলাকার ফুটপাতের বাসিন্দা ফাতেমা বেগমের। এমন বাস্তবতায় করোনার বিস্তার রোধে বেঁধে দেয়া স্বাস্থ্যবিধি-সামাজিক দূরত্ব, ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা আর ঘরে থাকার নির্দেশ- সবই উপহাসের মতো শোনায় করোনাকালে ঘরহীন রাস্তার মানুষগুলোর কাছে। কারো জন্য ‘সুরক্ষা’; আর কারো কাছে ‘জীবন মানেই যন্ত্রণা’। এমন বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেই এরা চলে গেছেন বোধ-বিবেচনার বাইরে। ফাতেমা বেগমের এই আক্ষেপটুকু সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতি আর বৈষম্যকেই যেন দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে। কারোনা দুর্যোগে ফাতেমা বেগমের মতো এমন অনেকেই অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। যারা এই সমাজেরই একাংশ। হাইকোর্ট এলাকা- রমনা, কমলাপুর, কাওরানবাজার রেলস্টেশন, এজিবি কলোনিসহ রাজধানীজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বস্তা, পলিথিন দিয়ে ঘর তুলে বাস করা ছিন্নমূল মানুষরা। যেখানে রান্না, খাওয়া সেখানেই দিনের শুরু আর রাত শেষ হয় এদের। এখন কাজ নেই তাই খাওয়াও জোটে না। ঘরে চাল নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। বৃষ্টি এলেই ভিজে একসা হয়ে যাওয়া রাস্তার এই মানুষগুলোর কাছে এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য সুরক্ষা যেন নিছকই বিলাসিতা। এমনকি এখানকার মানুষরা বিশ্বাসও করতে চান না আসলে করোনা ভাইরাস বলে কিছু আছে। তাদের ধারণা যদি এমন কিছু থেকেও থাকে সেটা কেবলই বড় লোকের জন্য। অথচ এদের মধ্যে যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাদের থেকে রাস্তায় চলাচলরত মানুষের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও কম নয়। তবুও এসব মানুষের কাছে পেটের ক্ষুধাই সবচেয়ে বড় মহামারি। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও বিত্তশালীরা কিছু সহায়তা দিলেও এখন আর কেউই তাদের খোঁজ রাখেন না।
করোনা থেকে বাঁচতে বারবার হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অথচ ফুটপাতে থাকা মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি একটি বড় সমস্যা। রমনা পার্কের পেছনের রাস্তায় দেয়ালে ঘর তুলে বাস করা ফরিদ জানালেন, প্রতিদিন হেঁটে কাওরান বাজার গিয়ে গোসল করেন এবং ফেরার সময় দুটি বড় বোতলে করে পানি নিয়ে আসেন। যা দিয়ে তার রান্না চলে, খাওয়ার জন্যও রাখতে হয়। বারবার হাত ধোয়ার বিলাসিতা তার জন্য নয়।
শান্তিনগরের এজিবি কলোনির রাস্তার দেয়াল ঘেঁষে বস্তা পেতে পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি তুলে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে সংসার পেতেছেন রাবেয়া। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। না মানলেই শাস্তির হুঁশিয়ারি রয়েছে শুনেই তার কণ্ঠে ঝরে পড়ল আক্ষেপ। কিছু আধাপচা সবজি ধারালো বঁটিতে টুকরো করছিলেন দ্রুত। রাবেয়া জানালেন, বাজারে সবজি বিক্রেতাদের ফেলে দেয়া তরকারি কুড়িয়ে এনেছেন রান্নার জন্য। ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট বাচ্চাটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই পোলাডারে নিয়া রাস্তায় থাকি, দুধ কেনার পয়সা নাই। ওর বাপ আগে ভাড়ায় রিকশা চালাইতো, এখন তাও বন্ধ। কই আপনেগো সরকার তো আমাগো দ্যাহে না’ আমরা মইরা গেলেই হ্যাগোর কি! আফনে যা কইলেন ওই যে বিধি, ওগুলা বড়লোকের ল্যাইগা।’ যৌবনকালে সন্তানকে পায়ের উপরে বালিস পেতে অনাহারী রাক্ষুসে রাজত্বের গল্প শোনাতেন যে মা, সেই খাদিজা বেগম যিনি আজ ভুলে গেছেন নিজের সন্তানদের নাম। খাদিজা বেগম কমলাপুরে ভিক্ষা করেন। স্টেশনের সামনের সড়কে পরিত্যক্ত যাত্রী ছাউনিকে ঘর বানিয়ে সেখানেই বাসা বেঁধেছেন কয়েকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। তিনিও তাদের একজন। যাত্রী কম, তাই ভিক্ষা মেলে না। ঘরে নেই, তাই দু’চোখে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে বসে থাকেন খাদিজা। [caption id="attachment_231043" align="aligncenter" width="700"] করোনাকালে ফুটপাথের জীবন[/caption] বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। ভাসমান খানা রয়েছে পাঁচ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে চার লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি। পৌরসভা এলাকায় আছে এক লাখ ৩০ হাজার ১৪৫টি। ৩২ হাজার ৯৬০টি রয়েছে অন্যান্য শহর এলাকায়। পরিসংখ্যানটিতে বলা হয়েছে, ভাসমান খানাগুলোর গড় সদস্য সংখ্যা ৩ দশমিক ৭৫ জন করে। এসব বস্তির বাসিন্দা ও ভাসমান মানুষগুলোর অনেকেরই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তবে এ নিয়ে তাদের মাঝে আতঙ্ক থাকলেও তার পরিমাণ কম। কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে তারা সেটাও জানেন না। এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় পৌনে দুই লাখ আক্রান্ত এবং আড়াই হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে কতজন সচ্ছল বা অসচ্ছল তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ ঢাকার পথে পথে অসংখ্য ঘরহীন মানুষের বাস যারা রাস্তায় ঘুপচি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপায় নেই। মাস্ক পরে না। ভাসমান মানুষকে স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে করোনা ভাইরাস আরো ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেছেন, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিই ভাসমান, ছিন্নমূল মানুষের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। করোনা থেকে বাঁচতে যেসব সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন, সেগুলো আরো সম্ভব নয়। তবে ভাসমান মানুষের মধ্যে করোনার বিস্তার রুখতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। ছিন্নমূল মানুষকে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখতে হবে। জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দিয়ে নিরাপদ ঘরে রেখে তাদের খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা সিটি করপোরেশনগুলোর চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ভাসমান মানুষের সুরক্ষায় উদ্যোগ নেয়ার কথা জানালেও তা চোখে পড়ছে না। দুই সিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে তা সমন্বয় করা হবে। এর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রমনা এলাকার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ভাসমান মানুষের করোনা সুরক্ষাসামগ্রী সম্পর্কে করপোরেশন থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে তাদের ত্রাণ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কাউন্সিলরদের ত্রাণ হিসেবে সরকার থেকে শুধু চাল দেয়া হয়। বাকি তেল, লবণসহ অন্যান্য সামগ্রী নিজের টাকা দিয়ে কিনে দিতে হয়। সবকিছু তো কাউন্সিলরদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষরা। যদিও এটার জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়। এ অবস্থায় আগে থেকেই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো আরো শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন ছিল। সুরক্ষা উপকরণগুলো আরো দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App