×

জাতীয়

সমালোচনার কেন্দ্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২০, ১০:০০ এএম

সমালোচনার কেন্দ্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ফাইল ছবি

দেশে কোভিড-১৯ দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। আর তাই করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমালোচনা পিছু ছাড়েনি স্বাস্থ্য বিভাগের। এন-৯৫ মাস্ক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ (পিপিই) কেলেঙ্কারি, কেনাকাটায় অনিয়ম, সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, সংকটেও নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি হাসপাতাল, করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতি এবং লাইসেন্সের মেয়াদ নেই জেনেও কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়াসহ নানা বিষয়ে সমালোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। দাবি উঠেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগের। সম্প্রতি সংসদের বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। নিজ দলের সিনিয়র নেতারাও মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে অসন্তুষ্ট বলে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি অবনতির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যর্থতা দায়ী। নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে এর দায়দায়িত্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে বলে মনে করছে তারা। করোনার এই সময়েও স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির যে চিত্র উঠে আসছে, তাতে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলেও মনে করেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, প্রথম থেকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভুল তথ্য দিয়ে আসছেন। বলা হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতির কথা। কতটা যে প্রস্তুতি ছিল তা এখন সবাই জানে। বলা হয়েছিল হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে। আইসিইউ, অক্সিজেন, পিপিই যথেষ্ট পরিমাণে আছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা না থাকার পরও মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগের সবাই বলেছেন তা আছে। সবাই মিথ্যাচার করেছেন। তাই পরিস্থিতির এত অবনতি। মন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করেছেন। শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা করোনার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বললেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কারণে রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) তা করতে পারেনি। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন মন্ত্রী। যা তিনি নিজেই বলেছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের আর দুর্নীতি তো এখন ওপেন-সিক্রেট? এসব কারণেই দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী। জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব মনে করেন, করোনা মোকাবিলায় সব দেশেই পূর্ব প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বড় ঘাটতি হচ্ছে সার্বিক সমন্বয় ও পরিকল্পনাগত নেতৃত্বের। যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। শুরু থেকেই যারা মন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন তারাও তাকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারেননি। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের কাজ পরামর্শ দেয়া। কিন্তু বাস্তবায়ন করার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই। লকডাউনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, এমন মহামারি পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে নিচের দিকে যে চেইন অব কমান্ড বজায় রাখা দরকার ছিল, তা নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আবার অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকেও তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলো থেকে যখন যা সহযোগিতা নেয়ার দরকার ছিল সেটিও তিনি করতে পারেননি। ফলে শুরু থেকেই বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। সমালোচনার যত কারণ : এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে করোনাকালেও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির চিত্রটি সামনে আসে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর বেকায়দায় পড়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) কর্তৃপক্ষ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপ। এন-৯৫ মাস্কের নামে তখন নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি) হেলথ কেয়ার। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ছয়টি স্থানে ৪৪টি বুথ বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করে। শর্ত অনুযায়ী সংগৃহীত নমুনা সরকার নির্ধারিত ল্যাবে পাঠাবে। কিন্তু করোনার রিপোর্ট জালিয়াতি ও সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগে ২৪ জুন জেকেজি’র অনুমোদন বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকার বিষয়টি জেনেও ২১ মার্চ ‘কোভিড ডেডিকেটেড’ হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। র‌্যাবের অভিযানে কোভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট জালিয়াতি, রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি প্রকাশ পাবার পর ৭ জুলাই হাসপাতালটির দুটি শাখা (উত্তরা ও মিরপুর) বন্ধ করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকার পরও কেন রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি করা হলো এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব উম্মে হাবিবা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান জানান, বাধ্য হয়েই এই চুক্তি করতে হয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতাল স্বতঃস্ফ‚র্তভাবেই করোনা রোগীদের সেবা দিতে এগিয়ে এসেছিল। লাইসেন্স নবায়নের শর্ত দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। লাইসেন্স দুবার রিমাইন্ডার দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা নবায়ন করেনি। করোনার এই সংকটেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে পাশে পায়নি সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এবং সমন্বয় ছাড়া শুধু হুমকি দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না। শুধু তাই নয়, অনুমোদন পাওয়ার পরও ৭টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার করোনা পরীক্ষা করছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রী অন্যদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যরা কেউ তাকে গুরুত্ব দেয়নি। এ কারণে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু থেকেই বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলছে। ফলে বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য ২১টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১৭টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পাওয়ার পরও কেন তারা কার্যক্রম শুরু করছে না জানতে চাইলে জানানো হয়, মেশিন আসতে দেরি হওয়ার কারণে তারা শুরু করতে পারছে না। দ্রুতই তারা কাজ শুরু করবে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক সময়ে পিপিই সরবরাহ না করা কিংবা নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ করায় তাদের ঝুঁকিতে ফেলা হয়। এরই মধ্যে ৫ হাজার ৪১৯ জন চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়। মৃত্যু হয়েছে ৬৩ জন চিকিৎসকের। অথচ শুরু থেকেই মন্ত্রী বারবারই বলছিলেন পিপিইর অভাব নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের সিন্ডিকেটের তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বহুবার। এ কথা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সবাই স্বীকার করলেও তা স্বীকার করতে রাজি নন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ২২ জুন নোয়াখালী-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী নিজের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে দাবি করেন, স্বাস্থ্য খাত সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘মিঠু সিন্ডিকেটের’ মিঠু কোন ব্যক্তি আমার জানা নেই। সিন্ডিকেট কথাটা যে ব্যবহার হয় তা অতিরঞ্জিত। সিন্ডিকেট আমি তো দেখি না, আমার এখানে নেই। ছোট জায়গায় সিন্ডিকেট করা যায় না। সবই অতিরঞ্জিত। এদিকে, করোনার চার মাসে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ উঠে এলেও মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি হয়েছে মাত্র একটি। অভিযোগগুলোর তদন্ত না হওয়াকে দুঃখজনক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন নিষ্ক্রিয়তা দুর্নীতিকে আরো উৎসাহিত করবে। অন্যদিকে, দুদক বলছে, করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে দ্রুত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতে যাচ্ছে তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App