×

জাতীয়

ভাবমূর্তি সংকটে বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২০, ০৯:৪৫ এএম

ভাবমূর্তি সংকটে বাংলাদেশ

প্রতীকী ছবি

দুর্নীতি-অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলে এলেও করোনা মহামারি বিস্তারের পর নানা কেলেঙ্কারির কারণে তা প্রকাশ্যে চলে আসে। এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই কেলেঙ্কারি, করোনার নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতি, সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহাল দশা, বেসরকারি হাসপাতালে গলাকাটা বিল আদায় ও চিকিৎসকের অদক্ষতায় রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলা, একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার কারণে আগুন লেগে ৫ করোনা রোগীর দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এসব কারণে এখন বহির্বিশ্বে চরম ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বিশেষত টাকার বিনিময়ে মানুষকে ভুয়া করোনা ‘নেগেটিভ’ সনদ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর ‘সহজ ফায়দা’ লোটার জেরে এখন ‘কঠিন মাশুল’ গুনতে হচ্ছে বিদেশগামী বাংলাদেশি নাগরিকদের। দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের এই জঘন্য প্রতারণার পরিণতিতে গোটা বিশ্বের কাছে ‘অবিশ্বস্ত’ হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিদেশগামী বাংলাদেশিরা করোনামুক্ত সনদের কাগজপত্র দেখালেও তা আর বিশ্বাস করছে না কোনো দেশ। এশিয়ার চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের ইতালিসহ নানা দেশ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করেছে। ভাড়া করা যে বিশেষ বিমানে চড়ে তারা বিদেশ যাচ্ছেন, ওই বিমানেই ফের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বিমান গন্তব্যে পৌঁছানোর পর সে দেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ অন্যান্য দেশের যাত্রীদের গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের, এমনকি বিমান থেকেই বিমানবন্দরে নামতে দেয়া হচ্ছে না। এ ধরনের একাধিক দুঃখজনক ও লজ্জাকর ঘটনা ঘটেছে বিগত কয়েক সপ্তাহে। স্বাস্থ্যসেবার নামে এসব অসাধু ব্যক্তির অসততার পরিণতিতে বিদেশে গভীর হয়রানি ও ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। করোনা মাহামারির মধ্যে বিশ্বজুড়ে সতর্কতাবস্থার মধ্যে বিপুল বদনাম ছড়াচ্ছে বাংলাদেশের। এখনই একপ্রকার ‘একঘরে’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশ থেকে গত সোমবার ইতালি যাওয়া একটি বিশেষ বিমানের ২১ যাত্রী নিজেদের করোনা ‘নেগেটিভ’ দাবি করার পরও সেখানকার পরীক্ষায় ‘পজেটিভ’ শনাক্ত হন। ভুয়া করোনা সনদের ‘বদনাম’ ছড়িয়ে পড়ার জেরে রোমের দুটি বিমানবন্দরে অবতরণ করা ১৮২ বাংলাদেশির মধ্যে ১৬৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত বুধবার রোমের ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে অন্যান্য দেশের ৮০ যাত্রীর ব্যাপারে কোনো আপত্তি না তোলা হলেও একই বিমানে থাকা ১২৫ বাংলাদেশিকে বিমান থেকেই নামতে দেয়া হয়নি। দেশটির প্রথম সারির সবগুলো গণমাধ্যমে বাংলাদেশে এ জাতীয় ভুয়া করোনা সনদ সরবরাহের খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। ইতালির শীর্ষ দৈনিক ‘ইল মেসেজেরো’ তাদের প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম করেছে ‘বাংলাদেশ থেকে ভুয়া পরীক্ষা’। তারা জানায়, বাংলাদেশে মাত্র ৩৬ ইউরো বা সাড়ে ৩ হাজার টাকা হলেই ‘জ¦র’ নিয়েও দেশত্যাগ করা যায়। ‘লা নুয়েভা’ নামে সে দেশের আরেক প্রভাবশালী পত্রিকাও একই খবর ছেপেছে। দৈনিক ‘লেগো’ লিখেছে ‘সাড়ে ৩ হাজার টাকায় জ¦র নিয়েই বাংলাদেশ ত্যাগ’। বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক এ জাতীয় খবর প্রধান শিরোনাম হয়েছে দেশটির টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমেও। ইয়াহু নিউজের পার্টনার ‘ইয়াহু ফিনাঞ্জা’ লিখেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজরা মানুষদের ভুয়া ‘করোনা নেগেটিভ’ সনদ বানিয়ে দিচ্ছে যা দিয়ে সহজেই তারা দেশ ছাড়তে পারছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় কলামে বাংলাদেশিদের নজরদারিতে আনার জোরালো দাবি উঠেছে। গত মাসের মাঝামাঝি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড তাদের প্রতিবেদনে জানায়, করোনা পরীক্ষার ফলাফল ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হওয়ায় ঢাকা থেকে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করেছে টোকিও। করোনার ‘ভুয়া’ সনদ নিয়ে টোকিওতে নামার পর বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি যাত্রীর ‘জালিয়াতি’ বেরিয়ে পড়ে সেখানকার পরীক্ষায়। বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়াও। এই দুই দেশেই বিশেষ বিমানে বাংলাদেশিরা স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে উপস্থিত হন এবং সেখানকার পরীক্ষায় ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হন। আরো ১৭ জন বাংলাদেশি যাত্রীর একই ‘অপরাধের’ দায়ে চীনের ‘সাউদার্ন এয়ারলাইন্স’ ঢাকা থেকে সেদেশগামী সব ধরনের ফ্লাইট এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে অনেক মানুষ করোনা পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ রায় পাওয়ার পরও করোনা উপসর্গ নিয়েই মারা যাচ্ছেন। পরে মৃতের ময়নাতদন্তের সময়ে এসব ব্যক্তির ‘পজেটিভ’ থাকার বিষয়টি ধরা পড়ছে। দেশের মধ্যে মহামারির শুরু থেকেই এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে এলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার পরিণতিতে এখন এই একই প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলেও। গত এপ্রিলে জাপানে বেশ কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিমান। এসব বিমানের সব যাত্রী কাছেই ‘হেলথ ক্লিয়ারেন্স’ সনদ ছিল; কিন্তু সে দেশের পরীক্ষায় গিয়ে বিমানের ৪ জন যাত্রী করোনা ‘পজেটিভ’ শনাক্ত হন। এর শাস্তি হিসেবে মে মাস থেকে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ‘চার্টার্ড ফ্লাইট’ নিষিদ্ধ করে দেয় তারা। অপর একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চার যাত্রীর ক্ষেত্রে একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা হওয়ায় তা নিয়ে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে দক্ষিণ কোরিয়াও। জাপানে বাংলাদেশের ফ্লাইট নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আমাদের ওপর দোষটি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিমানে ওঠার পর গন্তব্যে পৌঁছে কেউ যদি ‘পজেটিভ’ শনাক্ত হন, সেটির দায় আমাদের ওপর চাপানো চলে না। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, এ জাতীয় ব্যাখ্যা দিয়েও করোনাকালের এই মহাদুর্দিনে রেহাই মিলছে না বিশ্বের কোথাও। একের পর এক এ জাতীয় ঘটনা ‘কলঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, অন্যরা যে অভিযোগই করুক না কেন, কাঁধ থেকে দায় ঝেড়ে ফেলারও কোনো সুযোগ নেই আমাদের। এখানকার করোনা পরীক্ষার পদ্ধতিটি মানসম্পন্ন নয়। অনেক প্রশ্ন রয়েছে এসব পরীক্ষা নিয়ে। গত ৩০ মে তারিখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কমিটির বৈঠকেও দেশে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা পদ্ধতি নিখুঁত করার ওপর জোর দেন তিনি। এদিকে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ১১০ দেশের বিমান পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জাপান। তাছাড়া, তারা বাংলাদেশের যাত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কোনো বিমান কোম্পানিকে নিষিদ্ধ করেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App