×

জাতীয়

ধূর্ত প্রতারক সাহেদের খুঁটির জোর কোথায়?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২০, ১০:২১ এএম

করোনার নমুনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়া অনুমোদনহীন হাসপাতাল রিজেন্টের মালিক ভুঁঁইফোড় সাহেদ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। তার বহুবিধ প্রতারণা ও অপকর্মের ব্যাপারে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে সমাজের যেসব স্বনামধন্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও আমলা তার সঙ্গে সখ্য রেখে চলতেন তারাও ‘থ’ বনে গেছেন। প্রতিনিয়ত প্রতারণার জাল বিস্তার করে ফুলে ফেপে উঠা সাহেদের খুঁটির জোর কোথায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সবমহলে। মূলত টিভিতে টকশো করে পরিচিত পাওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়াতেন সর্বত্র। অনৈতিক তদবির করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ‘টকশো’ করে পাওয়া পরিচিতি ব্যবহার করে টাকা কামানোর জাল বিস্তৃত করা ধূর্ত সাহেদ যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য গতকাল পুলিশের পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশন বিভাগকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, প্রতারণা মামলার আসামি সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি যেন দেশের বাইরে যেতে না পারেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে চিঠিতে। সাহেদের সব একাউন্ট জব্দেরও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাকে ধরতে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা হন্যে। এ প্রসঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়ম, অপরাধ ও প্রতারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চেয়ারম্যান (মো. সাহেদ) নিজেই ডিল করেছেন, অন্যান্য কয়েকজন কর্মীও ছিলেন। এখন চেয়ারম্যান পলাতক রয়েছেন। তাকে এবং জড়িত সবাইকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। পালিয়ে বাঁচার সুযোগ নেই। এদিকে সাহেদের অন্যতম সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তিনি রিজেন্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও)। র‌্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে অভিযান চালিয়ে শিবলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কিছু জানা সম্ভব হবে। এদিকে সাহেদের ভায়রা টিভি নাটকের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিহোম’র প্রধান মোহাম্মদ আলী বশিরকেও র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়েছে। বুধবার রাতে বনানী অফিস থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন র?্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। জানা গেছে, টিভি নাটকের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিহোম’র প্রধান মোহাম্মদ আলী বশির। ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে টেলিহোমের যাত্রা শুরু। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি নাটক প্রযোজনা করে আসছে। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ ‘টেলিহোম’র প্রধান মোহাম্মদ আলী বশিরের স্ত্রীর বোন জামাই। মোহাম্মদ সাহেদের অবৈধ টাকা দিয়ে বশির নাটক প্রযোজনা করতেন এমন তথ্যের ভিত্তিতেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে র?্যাব হেফাজতে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে র‌্যাবের অভিযানে আটক রিজেন্টের ৮ কর্মচারীর মধ্যে ৭ জনকে গতকাল ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আর একজন কিশোর হওয়ায় তাকে কিশোর আদালতের মাধ্যমে সংশোধানাগারে নেয়া হয়েছে। শুক্রবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনের এমন কোনো জায়গা বাদ নেই যেখানে সাহেদের যাতায়াত ছিল না। সারাক্ষণ ধান্দার খোঁজে থাকা প্রতারক সাহেদ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টাকা দিয়ে টকশোতে অংশ নেয়ায় লোকজনের কাছে চেনা মুখ হয়ে উঠেন। টকশোতে সরকারের গুণগান করায় প্রশাসনের লোকজনের নজরে আসেন তিনি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি মন্ত্রী, এমপি ও সচিবের দপ্তরে এবং অনেকের বাসায় যাতায়াত শুরু করেন। তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে নানাবিধ সুযোগ হাতিয়ে নেন। যাতায়াত করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও। রাষ্ট্রীয় সবরকম অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেতেন তিনি। ওইসব অনুষ্ঠানে গিয়ে একেকজনের সঙ্গে পরিচয় হলে পরে ঘনিষ্ঠতা করতেন তিনি। এরপর নানা রকম তদবির করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সেও তার নিয়মিত আনাগোনা ছিল। বিমানবন্দরে ব্যবহার করতেন ভিআইপি লাউঞ্জ। এসব কীভাবে হতো এ পশ্নের উত্তর খুঁজতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, প্রায়ই সাহেদকে টিভি টকশোতে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে ইতিবাচক কথা বলতে দেখা যেত। সবাই তাকে আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভাবত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নানান আবদার করে বসতেন। আত্রাই নদী ড্রেজিং, কক্সবাজারে সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণসহ অনেক কাজ নামে বেনামে হাতিয়ে নিতেন তিনি। বড় কর্তাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় মাঠ পুলিশও তাকে সমীহ করে চলত। ‘তেলবাজি করে’ আওয়ামী লীগের গত উপকমিটির সদস্য হওয়ায় তার প্রতারণার সাইনবোর্ড পোক্ত হয়। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের যোগসূত্র তৈরি হয় এ সুযোগ। কিন্তু এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও তিনি একই কায়দায় প্রতারণা করে গেছেন। ছিলেন দুর্নীতির তীর্থ হিসেবে পরিচিতি হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ। দুর্নীতির মানিকজোড় তারেক-মামুনের সঙ্গে তার সখ্য পুরনো। এখনো কারাগারে তিনি মামুুনের খোঁজ রাখেন। স্কাইপিতে যোগাযোগ হয় তারেক রহমানের সঙ্গে। গত কয়েকদিনে তার কুকীর্তির খবর ফাঁস হওয়ায় এতদিন যারা তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তারাও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রতারণা তার পেশা হওয়ায় কারো সঙ্গে পরিচয় হলেই তার নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নিতেন সাহেদ। টকশোতে দলের হয়ে কথা বলায় অনেক নেতা, মন্ত্রী ও আমলা তার জন্য বিভিন্নস্থানে ফোন করে বলেও দিতেন। যার মধ্যে বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার অন্যতম। ঢাকার বাইরে গেলে নিতেন পুলিশ প্রটেকশন! মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য, ছবি তোলা এবং প্রয়োজনে ফোন করে সাহায্য নেয়ার মধ্য দিয়ে সাহেদের অপকর্মের হাত পোক্ত হয় বলে র‌্যাব ও পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সাতক্ষীরায় নিজ গ্রাম ও আশপাশের মানুষের কাছে বাটপার হিসেবে পরিচিত সাহেদ নিজেকে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠভাজন বলে পরিচয় দিতেন। তিনি উত্তরা এবং মিরপুরে দুটি ভবন দখল করে রিজেন্ট হাসপাতাল পরিচালনা করে আসছিলেন। হাসপাতাল দুটিতে করোনা রোগীদের পরীক্ষা করানো হয় এমন প্রচারণা জোরেশোরে চালিয়ে তিনি অনেক মন্ত্রী, এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়তি নজর কাড়েন। আর অনুমোদনহীন ওই হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দিয়ে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। ১৯৪৭ সালের পর সাহেদের দাদা জমি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন। এরপর সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে তোলেন বসতি। সেখানকার করিম মার্কেটটি ছিল সাহেদের বাবা সিরাজুল করিমের। ১০ বছর আগে এই মার্কেটটি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এখন সেখানে তাদের সম্পতি নেই বললেই চলে। তবে প্রথম দফায় এসএসসি ফেল করা সাহেদ স্কুল জীবন থেকেই ‘বড়লোক হওয়ায় লোভে’ নানাবিধ অপকর্মে জড়িত বলে এলাকায় চাউড় রয়েছে। একটি সূত্রের দাবি, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে সাহেদকে বিভিন্ন জেলার তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রুমে নিয়মিত যাতায়াত করতেন সাহেদ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দিতেন। ওই কর্মকর্তা প্রায় ৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন এবং সাহেদ তার কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়, উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। এতে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে আটক আটজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ নয়জনকে পলাতক আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App