×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালের আকাশ করিডোর ১

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২০, ০৮:৫৭ পিএম

আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি এখন বিশ্ববিদিত। জিকেএস আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মকাণ্ড সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সীমান্তে ও আকাশের করিডোরে। যাদের প্রশ্রয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাদের ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাঁধে নিয়ে বললেন, বাংলাদেশ শেনজেন ভিসার আওতায় নেই বলে তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। আমাদের দেশের সংক্রমণ যদি কমে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা আমাদের অনুমতি দেবে।

আকাশের দরজা খুলেছে, নেই বাংলাদেশ যে আকাশ থিথ্রো এয়ারপোর্টের রানওয়ের কাছে, যে আকাশ গ্যাটউইকের টারমাক থেকে দূরে নয়, যে আকাশ ম্যানচেস্টার থেকে দেখা যায় সেই সব আকাশের দরজা খুলেছে। উড়োজাহাজ এখন সেখানে নামতে পারবে, সেখান থেকে উড়তে পারবে। কিন্তু সবার জন্য খুলেনি সে আকাশের করিডোর। সর্বশেষ ঘোষণায় ১০ জুলাই থেকে আকাশ কাদের জন্য খুলেছে তা জানিয়ে দিয়েছে আকাশ পরিবহন বিভাগ। তাদের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট আকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্থল ও জলপথ খুলেছে। এসব দেশের নাগরিকরা যখন এসে পৌঁছবেন তাদের কাউকেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে বন্দি করা হবে না। যাদের ব্রিটেন তার ‘ট্র্যাভেল করিডোরে’ ঢুকিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে- অ্যান্ডোরা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, অ্যান্টিগা ও বার্বুদা, গ্রিস, নরওয়ে, আরুবা, গ্রিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, গ্রেনাডা, রিইউনিয়ন, অস্ট্রিয়া, বাহামা, গডেলুপ, সান ম্যারিনো, হাঙ্গেরি, সিসেলিজ, হংকং, সার্বিয়া, বার্বাডোস, বেলজিয়াম, আইসল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, বোনেয়ার, সিন ইউস্টাসিয়ান ও সাবা, ইতালি, স্পেন, ক্রোয়েশিয়া, জামায়িকা, সেইট বার্থেলেমি, কুরাকাও, জাপান, সেইন্ট কিটস ও নেভিস, সাইপ্রাস, লিস্টেনস্টেইন, সেইন্ট লুসিয়া, চেক রিপাবলিক, লিথুয়ানিয়া, সেইন্ট পিয়েরে ও মিকেলন, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, ডোমেনিকা, ম্যাকাও, তাইওয়ান, ফ্যারো আইল্যান্ড, মাল্টা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ফিজি মরিশাস, তুরস্ক, ফিনল্যান্ড, মোনাকো, ভ্যাটিক্যান সিটি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ভিয়েতনাম, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া এবং নিউ ক্যালেডোনিয়া। এ তালিকাভুক্তদের সন্তুষ্টির ব্যাপার থাকতে পারে। কিন্তু এই তালিকার দেশ নিউজিল্যান্ড ব্রিটেনের সঙ্গে ‘রেসিপ্রোকেট’ করেনি, যেহেতু তাদের অগ্রাধিকার নিজ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করা, এ সুযোগ তারা ব্রিটেনকে দেয়নি। সে দেশে অবতরণ করতে হলে ব্রিটিশ উড়োজাহাজের কিংবা ব্রিটেন থেকে আসা যে কোনো এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন ভোগ করতে হবে; আর গ্রিস তো সাফ জানিয়ে দিয়েছে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ব্রিটেন থেকে আসা কোনো উড়োজাহাজ নামতেই দেবে না। সে তারিখ বাড়তেও পারে। ব্রিটেনের ট্র্যাভেল করিডোরে যারা ঢুকেছে, ব্রিটেনের বিবেচনায় তারা করোনা ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। ব্রিটেন যে দিন করিডোর খোলার ঘোষণা দিচ্ছে তখন সেখানে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৬ আর মৃত্যু ৪৪ হাজার ১৩১। সে সময় বাংলাদেশের অবস্থা কী? আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৯ আর মৃত্যু ১ হাজার ৯৯৭ (এখন দুটিই বেড়ে গেছে)। তাহলে তো বাংলাদেশ অন্তত ব্রিটেনের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায় আছে। সে ক্ষেত্রে ব্রিটেনের আকাশের দরজা বাংলাদেশের জন্য কেন খোলেনি- এ প্রশ্নটি অত্যন্ত যৌক্তিক। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় কর্মরত সাতজন পাশ্চাত্যদেশীয় রাজদূত করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাধির সময় বাংলাদেশে এর প্রকৃত অবস্থা ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের স্বাধীনতা থাকার ওপর জোর দিয়ে টুইটার বিবৃতি দিয়েছিলেন। এ বিবৃতির অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত হচ্ছে এ ব্যাধি নিয়ে প্রকৃত তথ্য গণমাধ্যম প্রকাশ করতে পারছে না। সত্য তথ্য প্রকাশ না করা দেশীয় জননিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরদিনই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদের কমবেশি গালমন্দ করেছেন, নাক গলানোর অভ্যাস বন্ধ করতে বলেছেন, তাদের অক‚টনৈতিক আচরণের নিন্দা করেছেন এবং সব মিলিয়ে তাদের বক্তব্যকে বলেছেন ‘দুর্ভাগ্যজনক, হতাশাব্যাঞ্জক এবং অগ্রহণযোগ্য’। আমরাও বাহবা দিয়েছি, আমাদের সদাচারী ক‚টনীতিবিদ আপনাদের রাজধানীতে বসে এমন করে কি নাক গলায়? গলায় না, সাহসও পায় না। সাহস পেলে চীনের দূত উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতিত হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলতেন, সৌদি আরবের দূত বাংলাদেশি গৃহকর্মীর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ঠেকাতে বিস্তর হৈচৈ করতেন, ভারতের দূত কাশ্মির নিয়ে মুখ খুলতেন, আমেরিকার দূত সে দেশের প্রেসিডেন্টকে যাচ্ছেতাই বলতেন, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ করোনামুক্ত না করে বাংলাদেশে পাঠানোর অপরাধে ইতালিকে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিতেন। সেই মুরোদের ঘাটতি আমাদের আছে। আমরা যতই মাথা উঁচিয়েই ‘মাথা নোয়াবার নই’ বলি না কেন, শেষ পর্যন্ত সুসম্পর্ক রক্ষা করার জন্য অনেক কিছুই বলি না। তো এবারের এই ধাক্কাটা সাত রাষ্ট্রদূতের ভোলার কথা নয়। সেই সাত দেশের রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতও ছিলেন। মন্ত্রীর তুলনায় রাষ্ট্রদূত যথেষ্ট ছোট কর্মকর্তা হলেও রাষ্ট্রদূতের নিজ দেশ মিথ্যা হলেও রাষ্ট্রদূতের কথাটাই বিশ্বাস করে এবং মন্ত্রীর কথাকে মনে করে ‘পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট’- বিভিন্ন কারণে মন্ত্রীদের রাজনৈতিক বিবৃতি প্রদান অনিবার্য হয়েও পড়ে- সর্দি-কাশি করোনা কোনো ব্যাপারই নয়- সেসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও হয়। যদি আকাশের দরজা খোলাকে একটি সূচক বিবেচনা করি তাহলে ব্রিটেনের ট্র্যাভেল করিডোরে আমরা যতদিন নির্দ্বিধায় ঢুকতে না পারছি মনে করতে হবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের যে তথ্য-উপাত্ত আমরা সরবরাহ করছি, আমাদের করোনা ভাইরাস চিকিৎসা সক্ষমতার যেসব মন্ত্রীবচন শুনে এসেছি এবং পৃথিবীকে শুনিয়েছি, তারা অন্তত সেসব কথা বিশ^াস করছেন না- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্র্যাভেল করিডোরে বাংলাদেশের অবস্থানই করোনা ব্যবস্থাপনার একটি বিকল্প সূচক হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ যতই বলুক লন্ডন যাচ্ছি, রোম যাচ্ছি, তার আগে নিশ্চিত হতে হবে সেখানকার এয়ারপোর্টে নামতে দিচ্ছে তো? তাদের আকাশ করিডোরে বাংলাদেশি হঠাও ধরনের কোনো স্ক্যানার বসিয়ে রাখেনি তো? বাংলাদেশ নাইবা থাকল ব্রিটেনের ট্র্যাভেল করিডোরে, এতে কেবল বাংলাদেশের নয়, ব্রিটেনেরও ঢের আর্থিক ক্ষতি। কাজেই করিডোর খুলে দিতে ব্রিটেনই আগ্রহী হবে সে প্রত্যাশা তো আমরা করতেই পারি। ব্রিটেন ব্রেক্সিট করে থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিবিধানের বাইরে চলে যায়নি। কাজেই ব্রিটেনের সঙ্গে আমাদের ব্যর্থতা ও সাফল্যের অনুরণন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি দেশগুলোতে ঘটবে। করোনা মুক্তির সনদ জালিয়াতি ও আকাশ ভাঙার কাহিনী কোভিড-১৯ নেগেটিভ বা করোনা ভাইরাস নেগেটিভ সনদ সংগ্রহ যে কঠিন কাজ নয় বাংলাদেশের জাতীয় বিমান পরিবহনের যাত্রীরা তা প্রমাণ করেছেন। জাপান, চীন ও কোরিয়াতে ঢাকা থেকে আকাশ পথে পৌঁছা যাত্রীদের কেউ কেউ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বলে ধরা পড়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা ও রাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। গুয়াংজুর ১৭ যাত্রীসহ অন্যরা গাঁটের পয়সা খরচ করেই ‘করোনা ভাইরাস নেই’ এই সনদ নিয়েই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিভিন্ন প্রহরা স্তর অতিক্রম করেছে। যেখানে নামিদামি হাসপাতালেই করোনা ভাইরাস নিশ্চয়নে কয়েকদিন লেগে যায় সেখানে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কেবল থার্মোস্ক্যান মেশিন দেখিয়ে পজিটিভ-নেগেটিভ নিশ্চিত করবে- এ প্রত্যাশা সমীচীন কিনা ভাবা দরকার। চীন তাৎক্ষণিকভাবে চার সপ্তাহের জন্য গুয়াংজু-ঢাকা-গুয়াংজু ফ্লাইট স্থগিত করেছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বলেছে, এতে তাদের দায়িত্ব নেই, দায়িত্ব ইমিগ্রেশন এবং এয়ারলাইন্সের। বাস্তবতা হচ্ছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের এ কাজের ম্যান্ডেট নেই এবং করোনা শনাক্ত করার কোনো ন্যূনতম সুবিধাও তাদের নেই। শেষ পর্যন্ত দায়টা গিয়ে এয়ারলাইন্সের ওপরও পড়বে, অথবা চার্টার্ড এয়ারক্রাফট হলে যারা চার্টার করেছেন তাদের ওপর। কিন্তু তাতে তো সমস্যার সুরাহা হয় না। জাপানি দূতাবাস বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়ে তাদের তালিকাভুক্ত যাত্রী টোকিও পাঠিয়েছে এবং কোরিয়াতেও গিয়েছে ভাড়া করা উড়োজাহাজ। যাত্রী শনাক্ত করেছে জাপানি দূতাবাস, জাপানের এয়ারপোর্টে যদি তাদের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয় তাহলে এ দায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কেন হবে? বাস্তবতা হচ্ছে চীন দূতাবাসই হোক কি কোরীয় কর্তৃপক্ষ- উভয়কেই নির্ভর করতে হয়েছে যাত্রী করোনা পজিটিভ নয় এই সনদের ওপর। ভুয়া সনদের রমরমা ব্যবসা যে হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের নাম ভাঙিয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করা, এখন কারাবাসী জিকেএসই বড় প্রমাণ। সঙ্গে আরো লটবহর নিয়ে যোগ দেয় রিজেন্ট হাসপাতাল। কিন্তু এখানে টেস্টের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন আছে- এক হাসপাতালে পজিটিভ অন্য হাসপাতালে নেগেটিভ এত নিত্যকার সংবাদ; আবার নেগেটিভ রোগী একদিনের ব্যবধানে বাস্তবিকই করোনা পজিটিভ হয়ে উঠতে পারেন। স্বাস্থ্য সনদ দেয়ার ম্যান্ডেট স্বাস্থ্য বিভাগের-অধিদপ্তরের। এয়ারপোর্টে এতদিন স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রম ছিল না- এই সংকট পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। আকাশপথের যাত্রী এবং বিমান পরিবহন কর্মচারীকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অথরিটি এবং সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল আমেরিকাতে এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এ কাজটা কি এয়ারপোর্টকে করতে হবে? এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল মহাপরিচালক স্পষ্ট করে বলেছেন, এয়ারপোর্টের ভেতরে যাত্রী জড়ো করে এ কাজটা করতে গেলে তাদের জীবন আরো বেশি করোনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে- এমনিতেই আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রায় নব্বই শতাংশ কমে গেছে, এয়ারপোর্টকে এখন জীবনের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা ঠিক হবে না। যে যাত্রী ভেতরে আসছে এবং যে যাত্রী বাইরে যাচ্ছে আমেরিকাতে উভয়ের স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্ব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের। এয়ারপোর্টে নিরাপত্তা যাচাই করে থাকে ট্রান্সপোর্ট সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ)। আমেরিকাতে তারাই কি করোনা শনাক্ত করবেন? টিএসএর কর্মকর্তা বললেন, ‘বন্দুক, ছুরি, বোমা এসব আমাকে দিয়ে অনুসন্ধান করানো হয়। যাত্রীর করোনা ভাইরাস আছে কিনা তাও কি আমাকে বের করতে হবে?’ বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে কী হতে যাচ্ছে এটা স্পষ্ট নয়। তবে এ প্রশ্নটা উঠতেই পারে চীন, জাপান ও কোরিয়া যদি এয়ারপোর্টেই ধরে ফেলতে পারে যাত্রীটি করোনা পজিটিভ আমরা পারব না কেন? এয়ারপোর্ট নিশ্চয়ই হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক নয়। সে প্রত্যাশা করা সঙ্গতও হবে নয়। আমেরিকান ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অথরিটির প্রায় ৮০০ কর্মী করোনাক্রান্ত, পাঁচজনের মৃত্যুও হয়েছে। এখন আরো বড় প্রশ্ন সামনে আসছে, সুস্থ মানুষ এয়ারপোর্টে গিয়ে ঘাতক ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন না তো? কাজেই একই সঙ্গে যাত্রী ও এয়ারপোর্ট কর্মীকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এয়ারলাইন্স কী করবে? আমেরিকান এয়ারলাইনের সিইও ডোগ পার্কার স্পষ্ট করে বলেছেন, তার সংস্থার কোনো কর্মচারী যাত্রীর ভাইরাস পরীক্ষার দায়িত্ব নেবে না। সরকারের যারা হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার এ কাজে সরকার তাদের নিয়োগ করুক। তার কথা যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। করোনা ভাইরাস টেস্ট একটি সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের ব্যাপার। এ কাজ দক্ষ ও অভিজ্ঞজনের করা উচিত, এয়ারলাইন কিংবা এয়ারপোর্ট অথরিটির নয়। সংকটের এটাই সমাপ্তি নয়। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী লক্ষণযুক্ত (সিম্পটোমেটিক) এবং লক্ষণবিহীন (অ্যাসিম্পটোমেটিক) দুই-ই হতে পারে- এখন দ্বিতীয় ধরনের রোগীর কথাই ইদানীং বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় দক্ষ ডাক্তারও ধরতে পারলেন না, কিন্তু বিদেশি এয়ারপোর্টে পৌঁছে এমন একজন রোগী মরণাপন্ন হয়ে পড়লে অতঃপর কী হবে? সব যাত্রী তখন কোয়ারেন্টাইনে, করোনা ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগে এয়ারলাইন্স নিষিদ্ধ, যাত্রীর খারাপ কিছু ঘটে গেলে এয়ারলাইন্সের বড় ধরনের সাজা, সাজার অর্থ দিতে দেরি করলে বিদেশি বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ক্রোক করা- এভাবে আরো কিছু জাতীয় এয়ারলাইন্স দেউলিয়া ঘোষিত হবে। এই ঝুঁকিটা টের পাচ্ছে বলেই এয়ার ইন্ডিয়া আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর তারিখ কেবলই পিছিয়ে দিচ্ছে, হিসাব-নিকাশ ঠিক না করে উড়োজাহাজকে কেবল সম্মানের প্রতীক মনে করে চালালে এয়ারলাইন্স তো ডুববে, রাষ্ট্রও ভুগতে থাকবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি এখন বিশ্ববিদিত। জিকেএস আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মকাণ্ড সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সীমান্তে ও আকাশের করিডোরে। যাদের প্রশ্রয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাদের ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও নেই। শেনজেন আকাশটি বেশ বড়, এ আকাশের নিচে আছে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্টোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, লাটভিয়া, লিস্টেনস্টেইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া, শ্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। আপাতত এসব দেশের আকাশ আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। এই দায়িত্বটিও পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাঁধে নিয়ে বললেন, বাংলাদেশ শেনজেন ভিসার আওতায় নেই বলে তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। আমাদের দেশের সংক্রমণ যদি কমে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা আমাদের অনুমতি দেবে। আকাশ ভেঙে পড়বে যেসব কর্মজীবী যেতে পারবেন না, তাদের। যাদের ভিসার মেয়াদ ফুরোবে, তাদের। বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে যাওয়া বিশেষ ফ্লাইটের কিছুসংখ্যাক যাত্রী করোনা ভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর ইতালির প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের করোনা মুক্তির ভুয়া সনদচর্চাকে শিরোনামে এনেছে, যাত্রীরা কোভিড-১৯ নেগেটিভ এবং ভ্রমণের জন্য নিরাপদ সনদ বহন করছিলেন। মিথ্যা সনদধারী বাংলাদেশিদের প্রতিহত করতে পারার সাফল্যে ইতালির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে একটি ভাইরাল বোমা নিষ্ক্রিয় করার গৌরবের কথা জানিয়েছে। জাল সনদধারী দেশের কুখ্যাতির কারণে ইতালি সরকার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সব ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়ে অক্টোবরে নিয়ে বাড়িয়েছে। ইতালির প্রধান দৈনিকের শিরোনাম করেছে : বাংলাদেশ থেকে করোনার জাল সার্টিফিকেট, সচিত্র এ সংবাদ সব ধরনের সামাজিক ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ তো অসংক্রামক রোগ নয়, এটা প্যান্ডেমিক-বিশ্বব্যাধি; অন্যদেশ আমাদের পাপের বোঝা কেন বইবে? স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতার অনেক খেসারত, দুর্ভাগ্যবশত বেসামরিক পরিবহন খাতকেই দিতে হবে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App