×

জাতীয়

স্বাস্থ্যসেবা এখনো সমন্বয়হীন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২০, ০৯:৪৩ এএম

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ৪ মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। কিন্তু এই ৪ মাসেও করোনা আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অনেকটা পিছিয়ে আছে সরকার। এখনো রোগীবান্ধব হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। নমুনা পরীক্ষার সুবিধা পৌঁছেনি দেশের ৪৩টি জেলায়। হাসপাতালের বেড সংখ্যা, আইসিইউ, অক্সিজেন ব্যবস্থা যে এখনো অপ্রতুল তা উঠে এসেছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথায়। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেছেন, হাসপাতালে যে মানের চিকিৎসা দেয়া উচিত তা দেয়া হচ্ছে না। আমি নিজেই তার প্রমাণ। পাশাপাশি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতে পারছে না, এই সমস্যা বাংলাদেশে প্রকট। এর আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন; কিংবা চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন তাদের স্বজনরাও জানিয়েছেন হাসপাতালগুলোর দৈন্য দশার কথা। সম্প্রতি জেকেজি হেলথকেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সরকারের অনুমতি নিয়ে জেকেজি নামের একটি সংগঠন করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে আসছিল। নমুনা সংগ্রহ করে কোথাও কোনো টেস্ট না করিয়ে নিজেরাই নেগেটিভ-পজেটিভ রিপোর্ট দিত। জালিয়াতি ধরা পড়ার পর তাদের সব বুথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরই সোমবার সামনে আসে রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতির চিত্র। তারাও নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিত। সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এই হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরায় অবস্থিত দুটি শাখা সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্টরা কীভাবে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে এবং মহামারির এই কালে রোগীদের নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন? দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগ দাবি করে আসছে রোগীদের জন্য সাধারণ বেডসহ প্রচুর আইসিইউও প্রস্তুত আছে। আরো নতুন আইসিইউ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। অথচ ৪ মাস পর যখন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি; তখন বলা হচ্ছে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড আছে মাত্র ৪০১টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে গতকাল মঙ্গলবার জানানো হয়, সারাদেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে সাধারণ বেড আছে ১৪ হাজার ৭৭৫ টি এবং আইসিইউ বেড আছে ৪০টি। এর মধ্যে ঢাকায় সাধারণ বেডের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫টি ও আইসিইউ বেড ১৪টি। সারাদেশে সাধারণ বেডে ৪ হাজার ১৫৬ জন এবং আইসিইউতে ২১০ জন রোগী ভর্তি আছে। ১০ হাজার ৬১৯টি সাধারণ বেড এবং ১৯১টি আইসিইউ বেড খালি আছে সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালের আইসিইউসহ সাধারণ বেড ফাঁকা থাকছে দাবি করা হলেও এর সুফল পাচ্ছে না রোগীরা। জানা যায়, সাধারণ বেড ও আইসিউ খালি থাকার কথা বলা হলেও কোনো হাসপাতালে খালি আছে তা রোগী বা তার স্বজনরা জানেন না। ফলে তাদের হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হয়। অন্যদিকে বেড বা আইসিইউ খালি থাকলেও তা প্রকাশ করা হয় না। কারণ ভিআইপিদের জন্য অঘোষিতভাবে কিছু রিজার্ভ রাখা হয়। নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সোমবার বলেন, মেডিসিন বিভাগের আইসিইউ বেডের চাহিদা সত্তে¡ও গাইনি ও সার্জারি বিভাগের আইসিইউ খালি থাকলেও চিকিৎসাগত কারণে সেখানে রোগী দেয়া যায় না। সেই জন্য আইসিইউ বেড খালি থাকলেও সেখানে রোগী দেয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব্বিদ্যালয় হাসপাতাল, গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালসহ বেশ কিছু হাসপাতালে কিছুদিন আগে মাত্র রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে। ফলে বেড ফাঁকা থাকতেই পারে। বেড থাকার পরও নানা উদ্দেশ্যে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বেড অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী আছে কিনা সেটিও দেখা দরকার। তারা বলছেন চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা না থাকলে বেড ফাঁকা থাকলেও তো কোনো লাভ নেই। যেসব জেলায় নমুনা পরীক্ষার ল্যাব নাই : ঢাকার বাইরে ২১ জেলায় ৩৪টি ল্যাব আছে। আর ল্যাব নেই ৪৩ জেলায়। ঢাকা বিভাগের ৯ জেলায় (ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর ও টাঙ্গাইল); চট্টগ্রাম বিভাগের ছয় জেলায় (বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর); ময়মনসিংহ বিভাগের দুই জেলায় (নেত্রকোনা ও শেরপুর); বরিশালের পাঁচ জেলায় (বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর); রাজশাহী বিভাগের পাঁচ জেলায় (চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও পাবনা); খুলনা বিভাগের সাত জেলায় (বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল ও সাতক্ষীরা); রংপুর বিভাগের ছয় জেলায় (গাইবন্ধা, কুড়িগ্রাম, নালমনিরহাট, নীলফামারি, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও); সিলেট বিভাগের তিন জেলায় (হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ) করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য কোনো ল্যাব নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বাড়ছে। এখনো গুরুতর অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে গেলেও প্রয়োজনীয় সেবা চাহিদা মতো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, দেশের ৪৩ জেলাতে এখনো করোনা পরীক্ষার কেন্দ্রই নাই। অথচ করোনা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়াচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চেষ্টার ত্রু টি নেই। যেখানে যা করা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এমনকি কন্ট্রোলরুমে ফোন করলে কোথায় গেলে আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া যাবে বা কোন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে সে ব্যাপারেও পরামর্শ এবং সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, সচেতনতার কারণে ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। যারা একটু স্বচ্ছল, তারা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে। অনেকে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়ায় তাদের মৃত্যুও হচ্ছে বাড়িতে। জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন চাপের মুখে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামর্থ্যরে সর্বশেষ সীমানা অতিক্রম করেছে। এ জন্যই মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। এদিকে, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় জরুরি ভিত্তিতে আরো ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিতে বিশেষ বিসিএস নেয়ার প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এর আগে কোভিড-১৯ সংকটে ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৫ হাজার নার্স। মেডিকেল টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App