×

জাতীয়

দুডজন ঠিকাদারের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২০, ১০:০৮ এএম

সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতে এক যুগ ধরে চলছে লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর জালিয়াতির মচ্ছব। এ খাতের অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি ও জালিয়াতির পেছনে রয়েছে ২ ডজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট। জালিয়াতি করে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এই ঠিকাদাররা। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের জালিয়াতি ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আজ বুধবার থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পর্যায়ক্রমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। পাশাপাশি এসব ঠিকাদারকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে গত ৫ বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারদের এই জালিয়াত চক্র। বাজারমূল্যের চেয়ে মেডিকেল যন্ত্রপাতির দাম ১৫০-২০০ গুণ বেশি দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে তারা। ২০১৬-২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ঘুরেফিরে এই ঠিকাদাররাই বেশির ভাগ কাজ পেয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার নামে জালিয়াতি করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্লট, বাড়ি, গাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছে তারা। শুধু দেশেই নয়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে এই সিন্ডিকেট। জালিয়াতি করে ঠিকাদারদের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতালের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকার তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে। এই দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে দুদক এরই মধ্যে ১১টি মামলা করেছে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কথা উঠলেই সবার আগে আসে আলোচিত ঠিকাদার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা আক্তারের নাম। নামে-বেনামে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতি এবং নিম্নমানের জিনিসপত্র সরবরাহ করে হাতিয়ে নিয়েছেন তারা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অনুসন্ধান শেষে ৩১৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক ৩টি মামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে। মামলার পর তদন্ত করছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মো. তৌফিকুল ইসলাম। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে আবজাল-রুবিনা দম্পতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আবজাল-রুবিনা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ঠিকাদার আবজাল দম্পতির দুর্নীতির কথা সবাই জানলেও আরেক দুর্নীতিবাজ বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের কথা কেউ জানে না। মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের আত্মীয়স্বজনের নামে রয়েছে ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫০-২০০ গুণ বেশি দামে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে মুন্সী সাজ্জাদ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় শত কোটি টাকা। আবজাল দম্পতি এবং মুন্সী সাজ্জাদের চেয়ে আরেকটু এগিয়ে ঠিকাদার জাহের উদ্দিন সরকারের দুর্নীতি। তার নিজ নামে এবং আত্মীয়স্বজনের নামে রয়েছে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক, মার্কেন্টাইল ট্রেড ও ইউনিভার্সেল ট্রেড নামের ৩টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে জাহের উদ্দিন প্রায় ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনুসন্ধানে নেমে দুদক দুর্নীতির এসব চিত্র খুঁজে পায়। দুর্নীতি ও অনিয়ম করে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দুদক কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠানোর ৬ মাস পর সম্প্রতি এই ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এবং করোনাকালে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে নিম্নমানের পিপিই, মাস্কসহ চিকিৎসা সুরক্ষাসামগ্রী পাঠানো জেএমআই কোম্পানির মালিক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। তবে কালো তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা মিঠু, আব্দুর রাজ্জাকসহ ৫চ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে কয়েক’শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজসহ স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করে সরকারের প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এসব দুর্নীতির সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে দুদক থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে ৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের। মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফেকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক, এলান করপোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম আমিন, তমা কনস্ট্রাকশন এন্ড কোং লিমিটেডের সমন্বয়কারী (মেডিকেল টিম) মো. মতিউর রহমান, মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডের পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান ও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে তলব করা হয়েছে। এর মধ্যে ঠিদাকার মো. আব্দুর রাজ্জাক, মো. মতিউর রহমান ও আমিনুল ইসলাম আমিনকে আজ বুধবার (৮ জুলাই) এবং মো. হুমায়ুন কবির ও মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কমিশন শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০১৭ সালেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করা হয়। ২০১৯ সালের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির (১১টি) উৎস ও তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। দুদকের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম কিছুটা টেনে ধরা সম্ভব হতো। এছাড়া ঢাকা, সাতক্ষীরা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে কমিশন থেকে ১১টি মামলা করা হয়। এই ১১টি মামলায় সম্পৃক্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হবে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশন জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন এন্ড মেসার্স এসকে ট্রেডার্স, এমএইচ ফার্মা, মেসার্স অভি ড্রাগস, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি, এসএম ট্রেডার্স, মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিক্যাল কোম্পানি, ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশন, এএসএল, বেয়ার এভিয়েশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App