×

মুক্তচিন্তা

অপুষ্টির ঘনঘটায় করোনায় বেঁচে যাওয়ারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২০, ০৭:০১ পিএম

করোনায় বেঁচে যাওয়াদের কী হবে? তারা অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে কিনা- এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভিটামিনহীন হয়ে বেঁচে থাকার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক হলেও ভাবনায় আসছে না সেভাবে। সুস্থ-স্বাভাবিক বা নিরোগভাবে বেঁচে থাকতে এমনিতেই প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ।

টিকাদান ও গ্রহণে বাংলাদেশের অব্যাহত সাফল্যকে পিছু টেনে ধরেছে মহামারি করোনা ভাইরাস। করোনা দুর্যোগে টিকাদানে স্থবিরতা। কোথাও কোথাও টিকাদানকেন্দ্রই বন্ধ। আবার কোথাও কোথাও খোলা থাকলেও অভিভাবকরা সংক্রমণের শঙ্কায় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। এক অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। নিষ্ঠুর হলেও বাস্তব। স্মরণ করতেই হয়, বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কারে ভূষিত হন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুরস্কারটি দিয়েছিল গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন-জিএভিআই। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘ইমিউনাইজেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। পুরস্কার তুলে দেন জিএভিআই বোর্ড সভাপতি ড. এনগোজি অকোনজো ইবিলা এবং সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ ফ্রাংকিলন বার্কলে। প্রধানমন্ত্রী পুরস্কারটি গ্রহণের পর উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের জনগণকে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের সাফল্যের গল্প শুনিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার আগে অনুষ্ঠানে প্রশংসাপত্র পাঠ করেন নাইজেরিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী ও জিএভিআই বোর্ড সভাপতি ড. এনগোজি অকোনজো ইবিলা। পত্রে তিনি বলেন, এই পুরস্কার তাদের জন্য, যারা শিশুদের জীবন রক্ষার জন্য জরুরি টিকাদানে উদ্যোগী হয়েছেন এবং কোনো শিশু যাতে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছেন। এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে টিকা বিষয়ে আজ বিশাল ছন্দপতন। শিশুর জন্মের পরপরই ৪২ দিনের মধ্যে দিতে হয় যক্ষ্মা প্রতিরোধে বিসিজি টিকা। আর ১৮ মাসের মধ্যে দিতে হয় ১০ ধরনের টিকা। এসব টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা ছিল বিশ্বের কোনো কোনো দেশের জন্য শিক্ষণীয়। করোনা সেখানে আজ কেবল খরা নয়, শঙ্কাজনক বর্তমান-ভবিষ্যৎকে অনিবার্য করে তুলেছে। করোনা পরিস্থিতিতে টিকা দিতে কিছুটা দেরি হলেও কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলবে না বলে স্বাস্থ্য বিভাগ আশ্বস্ত করলেও সংশয় কাটছে না। এ ধরনের দাপ্তরিক আরোপিত আশ্বাসে মানুষ আর ভরসা করে না। মাত্র ক’দিন আগে করোনা নিয়েও আশ্বাস ও অভয় কম দেয়া হয়নি। কেবল করোনা নয়, যে কোনো সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তা প্রমাণিত। কোভিড-১৯ মহামারিও তা আরেকবার দেখিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়ে থাকে প্রতি চার মাসে মানবজাতির মধ্যে একটি নতুন সংক্রমক রোগের সৃষ্টি হয়। গ্লোবাল ভাইরম প্রজেক্টের হিসেবে বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ ভাইরাস রয়েছে, যা মহামারি ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। এগুলোর অনেকের আবার পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে। মানবজাতির টিকে থাকার জন্য টিকার অপরিহার্যতার পথেই করোনার চোখ রাঙানি। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ এশিয়ার দেশে-দেশেও হাম ও রুবেলার টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত। প্রতি বছর দুই কোটির বেশি শিশুকে এসব টিকা দেয়া হয়। কিন্তু এক কোটি ৩০ লাখের বেশি শিশু এসব টিকা এখনো নেয়নি। করোনা ভাইরাসের কারণে এসব শিশুর টিকা নিতে পারার ব্যাপারে শঙ্কা রয়েছে। যা লাখ লাখ শিশুর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিশ্বে টিকাদান থেকে একেবারে বাদ পড়া অথবা আংশিকভাবে টিকা পাওয়া শিশুদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ (সংখ্যায় প্রায় ৪৫ লাখ) দক্ষিণ এশিয়ার। পাকিস্তান-আফগানিস্তান তাদের পোলিও টিকাদান কার্যক্রম স্থগিত করেছে। বাংলাদেশে স্থগিত হওয়া হাম ও রুবেলা টিকাদান কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে ৯ মাস থেকে ৯ বছরের মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেয়া। ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরামর্শগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন নিয়মিত টিকাদান অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশনা জারি করেছে। এর বিপরীতে আবার ইউনিসেফই সতর্ক করে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে শিশুরা তাদের জীবন রক্ষাকারী টিকা না পেলে এই অঞ্চল আরো একটি স্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে। শঙ্কাটা বাস্তবেও ফলতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে হাম ও ডিপথেরিয়াসহ কিছু রোগ-বিমারি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। যা খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। বিশ্বের মধ্যে স্থানীয়ভাবে পোলিও সংক্রমণ দেখা দেয়া দুটি দেশ- আফগানিস্তান ও পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেরই দেশ। এটিও আমাদের জন্য এলার্মিং। রোগের পাশাপাশি অপুষ্টির ঝুঁকিও ভর করেছে। আর তা শিশুদের সঙ্গে বয়সীদের জন্যও। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, অর্থনীতি এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বের অন্তত ৩ কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে যে, করোনার কারণে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় বিশ্বের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে করোনার জেরে বিশ্বের মানুষ বিশুদ্ধ খাবার, ফল আর সবজি সংকটে পড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও। করোনায় বেঁচে যাওয়াদের কী হবে? তারা অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে কিনা- এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভিটামিনহীন হয়ে বেঁচে থাকার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক হলেও ভাবনায় আসছে না সেভাবে। সুস্থ-স্বাভাবিক বা নিরোগভাবে বেঁচে থাকতে এমনিতেই প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ। সারাবছর অপুষ্টিতে ভোগেন তারা। তার ওপর এই করোনা দুর্যোগে তারা আরো পুষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। শুধু চাল-ডাল-তেল-আলুর বাইরে আরো কিছু ভাগ্যে জুটছে না এই শ্রেণিটির। মাছ-মাংস-ডিম, শাক-সবজি ও ফলমূলসহ প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাদ্য না পাওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তলানিতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের বুলেটিনে করোনার ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। নিম্নবিত্তরা পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে কি? সরকারিভাবে এখনো কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে পুষ্টি জোগানোর? নিম্ন আয়ের মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ায় পুষ্টিকর দূরে থাক স্বাভাবিক খাদ্য জোগাড়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ইত্যাদি খনিজ তাদের পেটে যায় না। অর্থাৎ বেঁচে গেলেও অপুষ্টিতেই থাকছে তারা। অপুষ্টিজনিত কারণে একদিকে যেমন অ্যান্টিবডি তৈরি না হওয়ায় রোগাক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে, অন্যদিকে কোষগুলোর কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, করোনায় মৃত্যুহার কমানোর প্রধান উপায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। সেটার জন্য খাদ্য তালিকায় উজ্জ্বল রঙের ফল কমলালেবু, পেঁপে, আঙুর, আম, কিউই, আনার, তরমুজ, বেরি, জলপাই, আনারস এবং পারপেল-লাল পাতাকপি, বিট, ব্রোকলি, গাজর, টমেটো, মিষ্টি আলু ও ক্যাপসিকামসহ উজ্জ্বল রঙের সবজি, ডিম, সবুজ শাক, মুরগির মাংস, কলিজা, দুধ জাতীয় খাবার, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তা বাদাম, বাদাম তেল, ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার, আমলকী, লেবুসহ বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, ই, সি সমৃদ্ধ খাবার রাখার কথা বলছেন স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। যেখানে চাল-আলু-ডালই জোগাড়ের অবস্থা নেই, সেখানে এই ম্যানু বাতলানো পরিহাসের মতো। ত্রাণের আলু ভর্তা-ভাজি খেতে যে তেল-পেঁয়াজ-মরিচ-লবণ লাগবে তা কেনার টাকাই যাদের হাতে নেই তাদের ফলমূল, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ খাওয়ার কথা বলা মশকরার নামান্তর।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App