×

জাতীয়

হাটেই হাঁড়ি ভাঙবে ‘করোনা’!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২০, ০৯:৪১ এএম

দেশে করোনা ভাইরাসের চূড়ান্ত সংক্রমণ কবে হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু যখনই হোক, আমাদের দেশের বাস্তবতায় তা যে খুব ভয়াবহ হবে এ নিয়ে সবাই একমত। বিশেষত আসন্ন কুরবানির ঈদ ও গরুর হাট ঘিরে এই আশঙ্কা আরো তীব্র হয়েছে। যদিও দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন সব হাটেই মেনে চলতে হবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি। পশুর হাটে থাকবে ম্যাজিস্ট্রেটের টহল। নির্দেশনা মেনে না চললে ইজারা বাতিল করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এদিকে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে সব ক্ষেত্রে ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ চলার দোহাই দিলেও বাস্তবে যে তা কেউ মানছে না তা স্পষ্ট। করোনা সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। আক্রান্ত ও মৃতের তালিকা যখন ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে তখন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গরুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে ইজারাদারদের পকেট ভারি হবে বটে; কিন্তু করোনার সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নেবে ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হবে। এই পশুর হাটেই হয়তো হাড়ি ভাঙবে করোনা। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পশুর হাটের মধ্যে রয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মহানগর হাসপাতালের সামনের সড়ক। এই দুটি হাসপাতালই করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত। ওই দুই জায়গা থেকে হাট সরানো হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হক ভোরের কাগজকে জানান, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাটে এমনিতেই রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এর মধ্যে কোভিড হাসপাতালের সামনে হাট বসানোর সিদ্ধান্ত আরো বেশি উদ্বেগের। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, মানুষের মধ্যে এখনো সচেতনতার অভাব দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বারবার বলা হলেও মানুষ তা মানছে না। মাস্ক পরার হারটাও এখন কম দেখা যাচ্ছে। তাহলে কী করে আমরা পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানব? কতজন স্বেচ্ছায় মানবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপউপাচার্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক; আমাদের মতো দেশে বিশেষ করে শহর-নগরে পশুর হাট বসলে কোনোভাবেই শারীরিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করা সম্ভব হবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশুর হাট বসলে করোনা সংক্রমণের হারের সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়বে। বাড়বে গরিব মানুষের ভোগান্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মনে করেন এই পশুর হাট করোনার সংক্রমণ ঝুঁঁকি ও মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াবে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানও মনে করেন দেশে করোনার সংক্রমণ এখন বৃদ্ধির দিকে। পশুর হাট এই সংক্রমণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, করোনা প্রতিরোধে আমরা সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। চীনা বিশেষজ্ঞ দলতো বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জানিয়ে দিয়েছে, এখানে সমস্যা চিকিৎসায় নয়, সমস্যা অদক্ষতায়। রোজার ঈদে আমরা দেখেছি মানুষ গ্রামের বাড়িতে ছুটে গেছেন। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে ঈদ যে যেখানে ছিল সেখানেই উদযাপন করা দরকার ছিল। সামনে কুরবানির ঈদ। এই ঈদকে কেন্দ্র করে এখানে-সেখানে পশুর হাট বসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কুরবানির পশুর হাটের জন্য প্রস্তাবিত জনস্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগী অধ্যাপক ও কোভিড-১৯ বিষয়ক সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সদস্য সচিব ডা. রিজওয়ানুল করিম ভোরের কাগজকে জানান, হাট বসানোর জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে। হাট বসানোর আগে মহামারি প্রতিরোধীসামগ্রী যেমন মাস্ক, সাবান, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী প্রভৃতি সংগ্রহ; পরিষ্কার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা; নিরাপদ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন করা; পশুর হাটের সঙ্গে জড়িত সব কর্মচারী ও হাট কমিটির সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; হাটের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের স্বাস্থ্যবিধির প্রশিক্ষণ দেয়া; হাট কমিটির কর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা; যারা অসুস্থ অনুভব করবে তাদের নির্ধারিত স্থানে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা এবং দ্রুততম সময়ে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; হাটে প্রবেশের জন্য গেট তৈরি করে প্রবেশপথে তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণকারী যন্ত্র স্থাপন এবং শুধু স্বাভাবিক তাপমাত্রা (৯৮.৪ ফারেনহাইট) সম্পন্ন ব্যক্তিদেরই হাটে ঢুকতে দেয়া; মাস্ক ছাড়া কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা হাটের ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না; একটি পশু থেকে আরেকটা পশুর দূরত্ব কমপক্ষে ৫ ফুট নিশ্চিত করা; গণশৌচাগারে হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল সাবান, সাধারণ সাবান ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; অনলাইনে কুরবানির পশু কেনাবেচাকে উদ্বুদ্ধ করা; ক্রেতা/বিক্রেতাদের মূল্য দেয়া ও বের হওয়ার সময় সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা এবং সতর্কতার সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা; হাটে ক্রেতা/বিক্রেতাদের সংখ্যা ও তাদের চলাচল সীমিত করা; স্পর্শ ছাড়া মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করা প্রয়োজনে মূল্য পরিশোধ ও হাসিল আদায় কাউন্টারের সংখ্যা বাড়ানো; হাট কমিটির সবার ব্যক্তিগত সুরক্ষা জোরদার করা; মাইকিং, পোস্টার ও বুলেটিন বোর্ডের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য প্রচার করা; যদি হাটে সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগী থাকে তবে বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে অবহিত করা এবং প্রয়োজনে সিডিসির/স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App