×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২০, ০৮:০৫ পিএম

শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর থেকে সমর্থিত হচ্ছিল না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারকে দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং পঠন-পাঠন ও গবেষণার গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

করোনা মহাদুর্যোগে সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও অনেক কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই সংক্রমণ আর কতদিন অব্যাহত থাকবে- তা কেউ বলতে পারছে না। এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমরাও দারুণ সংকটে পড়ব- এতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনীতির বিষয়টি সবারই জানা আছে। শিক্ষাব্যবস্থা এখন শুধু বন্ধই নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা সেটি মস্তবড় জিজ্ঞাসার বিষয়। এরই মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তিমালিকানাধীন কেজি স্কুলসহ নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বলে কেজি স্কুল মালিক সমিতির সভাপতি গণমাধ্যমে বলেছেন। তার দেয়া তথ্য মতে, দেশে ৪০ হাজার কেজি স্কুলে ৬ লাখের মতো শিক্ষক কাজ করছেন। তাদের অনেকেই এখন জীবিকার অন্বেষণে অন্যকিছু করার চেষ্টা করছেন। শুধু কেজি স্কুলই নয়, বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই দীর্ঘ ছুটির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনটিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো এখন আর ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করতে পারছে না বলে বলা হচ্ছে। সরকারি স্কুল-কলেজ এবং এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সরকারি তহবিল থেকে পাচ্ছে। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের মাসিক টিউশন ফি না পাওয়ায় নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের সংস্থান করতে না পারার সংশয় আছে। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে গভীরভাবে ভাববার, এরই মধ্যে শহর থেকে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই সপরিবারে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। এর ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী শহরে আর ফিরে আসবে কিনা সেই সন্দেহ রয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থী সংকটে পড়তে যাচ্ছে এটি নিশ্চিত। এমনিতেই বাংলাদেশে গত সাড়ে চার দশকে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধারার অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলোর অনুমোদন দেয়ার তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক প্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে চলছে। কোনোটি পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষার্থী পাচ্ছে, কোনোটি পাচ্ছে না। শহরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে ভাড়া বাড়িতে বিভিন্ন ধারার নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখন এই সংক্রমণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভবিষ্যতে আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাবে বলে মনে করছে না। এমনকি গ্রামাঞ্চলেও কেজি স্কুল, মাদ্রাসা, বেসরকারি, নন-এমপিওভুক্ত নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর ফলে সর্বত্রই প্রয়োজনের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি বলে সবার জানা রয়েছে। এখন করোনা সংক্রমণের ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। বাস্তব অবস্থাটি হচ্ছে বাংলাদেশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেভাবে চলছে তাতে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদানের চেয়ে এক ধরনের শিক্ষা বাণিজ্যের প্রভাব কার্যকর রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা কোনো ধরনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়াই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং নিজেদের আর্থিক উপার্জনের বিষয় হিসেবে এটিকে নিয়েছেন। এছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকের বেশিরভাগই স্বল্প মাইনায় শিক্ষকতা করেন, প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি কিছু আয় উপার্জন করেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই মুহূর্তে বেশ সংকটে পড়েছে। সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক মালিকই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন, শিক্ষকদের অনেকেই শহর ত্যাগ করছেন কিংবা অন্য কোনো পেশা খুঁজে নিচ্ছেন। এক কথায় প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বড় সংখ্যক বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন আশা ছেড়ে দিয়েছে। আবার প্রভাবশালী এবং আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে মূলত শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য। উচ্চ মাধ্যমিক এবং বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকগুলোই অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত বা প্রশিক্ষিত নয়। সে কারণে তারাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অবস্থান নির্ধারণ করতে পারছে না। অল্প কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি অবস্থায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা খুবই নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। শহরের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরিবারের সঙ্গে ঘরে অবস্থান করছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ঘরেও বসে নেই, লেখাপড়ার সঙ্গেও তাদের খুব একটা সম্পর্ক নেই। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অনিশ্চয়তা যত বাড়চ্ছে তত শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। তবে একটি কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, করোনা-উত্তর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ববর্তী কাঠামো খুব একটা ধরে রাখা যাবে না, নতুন করে নতুন বাস্তবতায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা এখন থেকেই প্রণয়ন করা ছাড়া সরকারের সম্মুখে অন্য কোনো দ্বিতীয় সুযোগ বেশি নেই। বাংলাদেশে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে নানা ধারা-উপধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছিল তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুব একটা মঙ্গলজনক ছিল না। সরকারের পক্ষেও এসব ধারা-উপধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকি করা কিংবা শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার অবস্থান ছিল না। সরকার সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। একদিকে বিপুলসংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার পরও নানা ধরনের কেজি স্কুলের কারণে শিক্ষার্থীর সংকট অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল। একসময় এগুলোতে বেশ জড়াজীর্ণ অবস্থা যেমন ছিল, শিক্ষক স্বল্পতাও সেগুলোতে ছিল। সে কারণে শহরগুলোর শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব একটা ভর্তি হতো না। এদের সিংহভাগই ওইসব কেজি এবং বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় বেশকিছু পরিবর্তন সাধিত হওয়ার পরও শহরগুলোর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেকটাই ঢিলেঢালাভাবে চলছিল। গ্রামাঞ্চলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একই ধরনের প্রভাব পড়ছিল। তাছাড়া নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের প্রলুব্ধ বা উদ্বুদ্ধ করে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ে যেত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার প্রতিযোগিতা খুব একটা ছিল না। এখন করোনা পরিস্থিতির কারণে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তাতে সামগ্রিকভাবে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার মধ্যে একটি বড় ধরনের ভাঙন বা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এতে সরকারকে এখনই নিকট ভবিষ্যতে কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে এখনই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে ভাবতে হবে। শহরগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হয়তো গ্রামে চলে গেছে। সেখানে নিকটস্থ বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন কেজি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার করণীয়গুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের শিক্ষার্থীরা যেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী হয় সেই বিষয়টি এখনই ভাবা উচিত। আবার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের যাতে শিক্ষা জীবন মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু করা যায় সেই বিষয়ও এলাকাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে রাখা দরকার। গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার যেন পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এখনই জরিপ চালিয়ে রাখা দরকার। দ্বিতীয় যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা আগামী দিনের শিক্ষার মধ্যে গুণগত মান, বিজ্ঞান, কারিগরি, পেশাভিত্তিক এবং দক্ষ মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলার শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ খুব বেশি থাকবে না। এ কারণে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয়টি মাথায় রেখে করোনা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর একটি পরিকল্পনা এখনই প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দুর্বলতা অনেক বেশি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পঠন-পাঠন এবং উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। অনেকদিন থেকেই আমাদের দেশে বেকারত্ব সৃষ্টির দায় অনেকটা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর দেয়া হচ্ছিল। এর নানাবিধ কারণও রয়েছে। এতসব ধারা-উপধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা পরিবর্তন করার কোনো উদ্যোগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর থেকে সমর্থিত হচ্ছিল না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারকে দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং পঠন-পাঠন ও গবেষণার গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App