×

সারাদেশ

ধীরগতিতে কমলেও পানি এখনো বিপদসীমার উপরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২০, ১১:০১ এএম

ধীরগতিতে কমলেও পানি এখনো বিপদসীমার উপরে

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের বামনা গ্রামের বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শুকনো জায়গার সন্ধানে ছাগল নিয়ে যাচ্ছে এক কিশোর -ভোরের কাগজ

দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ধীরগতিতে কমলেও গতকাল রবিবার পর্যন্ত বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহিত হয় বিপদসীমার ৪৩ সেন্টমিটার উপর দিয়ে। এদিকে টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার, ঝিনাই নদীর পানি ২৯ সেন্টিমিটার আর ধলেশ্বরীর পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। এছাড়া টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায় বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রক্ষা দ্বিতীয় গাইড বাঁধ ভেঙে ২৩টি ঘরবা?ড়ি নদীগ?র্ভে চ?লে গে?ছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কমলেও ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ঘরে ফিরতে পারছেন না বানভাসিরা। দেড় সপ্তাহ ধরে বন্যার পানি অবস্থান করায় দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসাসহ জ্বালানি ও গো-খাদ্যের সংকট। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বন্যায় ৩টি পৌরসভাসহ ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ মানুষ। নদীভাঙনে গৃহহীন হয়েছে ৫০০ শতাধিক পরিবার। ২৯.৫০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৩৭ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কৃষিতে আউশ, আমন বীজতলা, পাট, কাউন, তিল, শাক-সবজিসহ বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৯ হেক্টর ফসলি জমি। ইতোমধ্যে জেলার দুর্গত মানুষকে সহায়তার জন্য ৯টি উপজেলায় ৩০২ টন চাল ও ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বানভাসিদের মাঝে সেগুলো বিতরণ চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। রাজবাড়ী : গত কয়েক দিন পদ্মা নদীর রাজবাড়ী অংশে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পর গত ২৪ ঘণ্টায় গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৪৩ সেন্টমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রবিবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানির এ পরিমাপ করেছে রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. ইউসুফ আলী খান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দৌলতদিয়া পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। পানি কমার পরও রবিবার বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ও দেবগ্রামের তিনটি চর এবং কালুখালীর হরিণবাড়িয়া চরের ফসলি জমিসহ জেলার নদী তীরবর্তী নিচু ফসলি মাঠে পানি উঠতে শুরু করেছে। এতে তলিয়ে গেছে কৃষকদের ধান ও পাট। এতে ফসলের মাঠে আসা-যাওয়া ও কৃষিপণ্য পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে কৃষকদের। জেলা প্রশাসক দিলাসাদ বেগম জানান, পদ্মার পানি বৃদ্ধিতে প্রতি বছর জেলার নিম্নাঞ্চল আগে প্লাবিত হয়। ফলে এবার নিজ নিজ উপজেলার ইউএনও, পিআইওসহ সংশ্লিষ্টদের সার্বক্ষণিক নজদারি করার নির্দেশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। সিরাজগঞ্জ : উজানের সঙ্গে যমুনায় পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুরের ঘাটাবাড়ী ও পাকুরতলায় ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। পাউবোর উদ্যোগে অস্থায়ী জরুরি প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হলেও ভাঙন কোনোভাবেই থামছে না। থেমে থেমে ভাঙনে মানুষজন ক্রমেই বসতভিটা, ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। বিগত কয়েক বছর থেকে ভাঙন দেখা দিলেও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে পারেনি পাউবো। এনায়েতপুরের ঘাটাবাড়ী ও পাকুরতলায় রক্ষায় প্রায় ৬৪৬ কোটি টাকার সাড়ে ৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে তীর রক্ষা প্রকল্প জমা দেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে ভাঙন ঠেকাতে করোনার মধ্যে সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে নদীর পাড়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন অসহায় মানুষজন। জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে দাবি তাদের। পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম রফিকুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে রবিবার দুপুরে পানি বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার উপরে রয়েছে। এনয়েতপুরের ঘাটাবাড়ী ও পাকুরতলায় অস্থায়ী প্রতিরক্ষার কাজ চলছে, তারপরেও খোলা অংশে থেমে থেমে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। জেলার প্রায় ৮০ কি.মি. বাঁধ এখনো সুরক্ষিত রয়েছে। পানি বাড়লেও বাঁধের কোনো ক্ষতি হয়নি। যমুনার পানি আগামীতে কমার সম্ভাবনা রয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ৬৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় সাড়ে ৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে তীর রক্ষা প্রকল্প পাস হলে ওই অঞ্চলে ভাঙন প্রতিরক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। প্রকল্পটি প্রি-একনেক হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে থমকে রয়েছে। টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার, ঝিনাই নদীর পানি ২৯ সেন্টিমিটার আর ধলেশ্বরীর পানি বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার ছয় উপজেলায় এক লাখ ২৪ হাজার ৫৭১ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে তিন হাজার ৬১৩ হেক্টর ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র জানায়, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পর্যন্ত টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, দেলদুয়ার, ভ‚ঞাপুর, কালিহাতী ও গোপালপুর উপজেলার ২৪ ইউনিয়নের অন্তত ১৩৭ গ্রাম ডুবে গেছে। কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার কিছু এলাকা ডুবে গেছে। এদিকে বন্যায় ৫৩২ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সেই সঙ্গে ৮৭৫ পরিবারের ঘরবাড়ির নদীতে চলে গেছে। নাগরপুরে একটি স্কুল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যায় ছয় উপজেলার ১৪৭ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত হয়েছে। জেলায় এখন পর্যন্ত ৩৬.৫ কিলোমিটার (আংশিক) কাঁচা সড়ক এবং এক কিলোমিটার (আংশিক) পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুটি কালভার্ট (আংশিক) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনটি টিউবওয়েল এবং ২.৫ কিলোমিটার (আংশিক) নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় ৩০০ টন জিআর চাল ও আট লাখ টাকার চাহিদা রয়েছে। রবিবার পর্যন্ত ২০০ টন চাল ও নগদ তিন লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার। জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, বন্যায় এ পর্যন্ত জেলায় তিন হাজার ৩৭১ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে বোনা আমন ৯৬৯ হেক্টর, রোপা আমন ছয় হেক্টর, পাট ৩৮৭ হেক্টর, আউশ ধান ৭০৬ হেক্টর, সবজি ২১১ হেক্টর ও তিল ১০৯২ হেক্টর। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আহসানুল বাশার বলেন, পানি নেমে গেলে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ ফসলি জমির ক্ষতি হবে না। এ ব্যাপারে কৃষি অফিস কাজ করছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, যমুনা আর ঝিনাই নদীর পানি কিছুটা কমলেও ধলেশ্বরী, পুংলী, বংশাই, ফটিকজানি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মান্দা (নওগাঁ) : মান্দা উপজেলার জোতবাজার পয়েন্টে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নদীর পানি বিপদসীমায় অবস্থান করলেও গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বেড়েছে ৪০ সেন্টিমিটার। ইতোমধ্যে নদী সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আত্রাই ও ফকির্ণি নদীর অন্তত ২০টি পয়েন্ট। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান জানান, আবহাওয়া পরিষ্কার হলে দুয়েক দিনের মধ্যে পানি কমতে শুরু করবে। পানি বাড়তে থাকায় বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো তদারকি করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন। বাঁধ টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইব্রাহীম হোসেন জানান, ২০১৭ সালের বন্যায় চকরামপুর ও কয়লাবাড়ী বেড়িবাঁধ ভাঙার পর আর মেরামত করা হয়নি। নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব ভাঙন স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করে দুই গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির চাপে আত্রাই ও ফকির্ণি নদীর উভয় তীরের পারনুরুল্লাবাদ বেড়িবাঁধ, বনকুড়া, চকরামপুর, কয়লাবাড়ী, শহরবাড়ী ভাঙ্গিপাড়া, নিখিরাপাড়া, শামুকখোল, লক্ষ্মীরামপুরসহ অন্তত ২০টি পয়েন্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে শামুকখোল নমঃশূদ্রপাড়া এলাকায় আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে পানি পাড় হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বাঁধটি টিকিয়ে রাখতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছেন। মান্দা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল হালিম বলেন, নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App