×

মুক্তচিন্তা

দুর্ঘটনা না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২০, ০৬:০৮ পিএম

গত সোমবার সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা মর্নিং বার্ড নামের ক্ষুদ্র দোতলা লঞ্চটি গন্তব্যস্থল শ্যামবাজার কাঠপট্টির ২০০ গজ দূরে ময়ূর-২ নামের একটি দৈত্যাকৃতির লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। ময়ূর-২ ডুবন্ত লঞ্চটির ওপর উঠে যাওয়ায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপকসংখ্যক যাত্রী প্রাণ হারান। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। উদ্ধার কাজের সময় উপস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের অসতর্কতায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে কর্মীদের অসতর্কতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতার জন্য। লঞ্চ মালিকরা যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বদলে কম পয়সায় আনাড়িদেরও নিয়োগ দেন- এমন অভিযোগ রয়েছে। লঞ্চের ফিটনেসের সংকটও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এসব দিকে সতর্ক হলে নৌদুর্ঘটনায় লাগাম পরানো সম্ভব হবে। করোনাকালে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া লঞ্চের সিংহভাগ যাত্রীর প্রাণহানি এক বিয়োগান্ত ঘটনা। কিছু মানুষের অসতর্কতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ নিহতদের পরিবারের জন্য যে ট্র্যাজেডি বয়ে এনেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। এ প্রবণতার অবসান হওয়া উচিত। প্রায়ই নদীতে নৌদুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো কোনো দুর্ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা এবং দুর্ঘটনার সঠিক প্রতিকার না হওয়ায় এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি যেন একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। অতীতেও এমন অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় নৌযানের মারাত্মক ত্রুটি, অবহেলা, বেপরোয়া মনোভাব ও আইন লঙ্ঘনের চিত্র ধরা পড়লেও তার প্রতিকার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই যথারীতি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, তদন্তের রিপোর্টও জমা হয়। কিন্তু সুপারিশমালার বাস্তবায়ন বা দায়ীদের শাস্তির নজির না থাকায় একই ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। বুড়িগঙ্গায় দুর্ঘটনার তদন্তেও ইতোমধ্যে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, নৌপরিবহন সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। দেশের নৌপথের সংস্কার, নদীর নাব্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নৌপরিবহনের আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌপরিবহনের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। এজন্য নৌপরিবহনের ফিটনেস, নৌচালকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামগ্রিক বিষয়ের ওপর উপযুক্ত মনিটরিং ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত কালবৈশাখী, ঘন কুয়াশা এবং অন্ধকার রাতে দিক হারিয়ে ফেলা, যান্ত্রিক ত্রুটি এবং অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বোঝাইয়ের কারণে নৌদুর্ঘটনা হয়ে থাকে। বুড়িগঙ্গার দুর্ঘটনার পেছনে এর কোনোটিই ছিল না। একটি বড় লঞ্চের নবিস, অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের কারণে এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। নৌদুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না, বছরে দুয়েকটি দুর্ঘটনায় শত শত মানুষ মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ বছরে ১২টি বড় নৌদুর্ঘটনায় দেড় হাজার যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন এবং রিপোর্ট পেশ করা হলেও, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে এ দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সামনে পবিত্র ঈদুল আজহা। ভরা বর্ষা এবং বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ঈদের ছুটিতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ লঞ্চে চড়ে বাড়ি ফিরবে। তার আগে এই লঞ্চ দুর্ঘটনা প্রত্যেকের মধ্যেই যে ভীতি সঞ্চার করবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে নৌদুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে সতর্কতা ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো স্থানে যে কোনো নৌদুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের গাফিলতি ও শৈথিল্য কাম্য হতে পারে না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App