×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালের জার্নাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২০, ০৬:৩৮ পিএম

ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে বলে মচ্ছব কম করিনি, ফেনা উঠেছে মুখে। বহু বছর আগে থাইল্যান্ডের তখনকার প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার রাজনৈতিক দলটির একটি ডাটাবেইজ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল, দেশের প্রতিটি মানুষের বিবরণী তাতে আছে, বাটনের এক টিপেই সব স্ক্রিনে চলে আসে। আমাদের ডিজিটাল ডাটাবেইজে কি কেবল বণ্টনকারী চেয়ারম্যানের নাম আছে? জনগণ তাতে নেই। আছে মৃত মানুষ, আছে ধনবান প্রবাসীও ওএমএসের তালিকায়।

(গতকালের পর)

চীনবান্ধব আমেরিকা না ভারতবান্ধব আমেরিকা করোনা ভাইরাসকে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা ভাইরাস কিংবা উহান ভাইরাস বলে আখ্যায়িত করেছেন, চীনের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছে। ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়েছে ভারত। অস্ট্রেলিয়াও দোষারোপ করেছে। সম্প্রতি সীমান্ত সংঘর্ষের পর পুরনো প্রশ্নটাই ভারতীয় অঙ্গন থেকে উত্থিত হয়েছে। সাউথ চায়না সি-তে চীনের দুষ্কর্ম নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্টের (ফিলিপিন্স বনাম চীন, নাইন ড্যাশ লাইন অধিকার নিয়ে কোর্টের রায় এবং আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার নির্দেশ, এতে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপিন্স এবং দক্ষিণ পূর্ব দেশের পক্ষে লড়েছে) আদেশ দেখিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না কেন? চীন কখনো বিশ্বশান্তিতে কোনো অবদান রাখেনি বরং চীন বরাবরই বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমেরিকান উত্তরদাতা শুরুতে প্রশ্নকর্তাকে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য গালাগাল দিয়ে এবং আমেরিকার সঙ্গে ভারতের নতুন সম্পর্কের মুণ্ডুপাত করে বললেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কাউকে লাথি মেরে জাতিসংঘ থেকে বের করে দেবে না, কারণ আমাদের কাছে জাতিসংঘ মোটেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নয়। জাতিসংঘকে কে পাত্তা দেয়? জাতিসংঘ ছোট ছোট দেশগুলোকে যৎসামান্য সাহায্য করার জন্যই। কখনো কখনো আমেরিকার স্বার্থ থাকলে বড় প্রতিবেশীর আক্রমণ থেকে রক্ষাও করে থাকে- অবশ্য সেই বড় দেশ যদি জাতিসংঘের বিধিবিধান মান্য করে তবেই। জাতিসংঘ না থাকলে কার ক্ষতি হবে একবার ভেবে দেখুন। প্রচুর সম্পদের অধিকারী কিন্তু প্রতিরক্ষার ক্ষমতা নেই এমন কিছু দেশ- আর দশটি রাখব বোয়ালের মতো দেশ চোখের পলকে এগুলোতে দখল করে নেবে। আমেরিকাই সবার আদুরে এই বিড়াল জাতিসংঘকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সবাইকে আদর করার সুযোগ করে দিচ্ছে, কিন্তু কাউকেই বাড়ি নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। জাতিসংঘ না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই এসে যায় না। এমনিতেই এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমরশক্তি। দুটি মহাসাগর এ দেশকে সুরক্ষিত রেখেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বড় মহাজনেরা জানে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টাকা নষ্ট করার প্রয়োজন তাদের নেই। সেজন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তারা নিজেদের দরকষাকষি সেরে নেয়। সমঝোতা স্থাপন করে। মনে রাখবেন আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বড় সামরিক শক্তিগুলো প্রক্সি দেশে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে, নিহত হয় তাদের সন্তান। আমাদের হাতে অস্ত্র বেচা টাকা আসে, আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়িত হয়। উত্তরদাতা ভারতের সমাজতন্ত্র যাত্রা, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি, দফায় দফায় আমেরিকান দূতাবাস ঘেরাও আমেরিকায় উল্টোশিবিরে ভোট প্রদান সব মিলিয়ে ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত, তিনি মনে করেন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব যতই থাকুক যুক্তরাষ্ট্র কখনো চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ ভারতের চেয়ে চীনের সঙ্গেই বেশি। বার্ষিক বাণিজ্যের আকার ৬০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যকের চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। ভারত তার রক্ষণশীল কৃষি বাজার খুলে না দেয়ায় আমেরিকা প্রবেশ করতে পারছে না। এমনকি নিজের লোকদের বেতন-ভাতা দেবার প্রশ্নেও ভারত কার্পণ্য করছে। ভারতীয়রা আমেরিকার এইচওয়ান-বি ভিসার অপব্যবহার করছে। কিছু পেতে হলে হাত তো খুলতে হবে। কংগ্রেসম্যানরা খালি হাতে কারো জন্য কিছু বলবে না। সুতরাং ভারত যতই চাক আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ লাগবে না। নেহেরুর আমল থেকেই অনেকবার ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আসার আমন্ত্রণ আমেরিকা দিয়েছে। নেহরু চীনকে ধাক্কা দেয়ার প্রশ্নে আতঙ্কিত ছিলেন। চীন বলছে ভারতকে নিয়ে স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়া এমনকি সম্মত হলেও চীন তার ঐতিহাসিক ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ভারতকে ঠেকাবে। দেশীয় রাজনীতিতে যেমন অদ্ভুত শয্যাসঙ্গীর সাক্ষাৎ মেলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও জোট গঠনেও শত্রæর সঙ্গে সহবাসে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মার্কিন উত্তরদাতা মনে করেন চীনের যত ভেটো ক্ষমতা থাকুক না কেন এটা কখনো চীন-আমেরিকান অর্থনৈতিক স্বার্থের যে জোট তার বিরুদ্ধে যাবে না। আমেরিকার অর্থনৈতিক মিত্র ভাববে চীনকে এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য রাজনৈতিক মিত্র বানাবে রাশিয়াকে। আমেরিকা যত আশ্বাসই দিক থার্ড চাইল্ড- তৃতীয় সন্তান হয়ে লাফাতে হবে ভারতকে। অস্ত্র ব্যবসায় ঠিক রাখতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা ও বন্ধুত্ব দুই-ই রক্ষা করতে হবে। আমেরিকা-ভারতের কাছ থেকে পাবার মতো আমেরিকার তেমন বড় কিছু নেই। এই মূল্যায়নটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

করোনার সাদা ও কালো কার্ল মার্কসের তত্ত¡ এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি সাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশেও রাঘব বোয়ালরা সব সমানের মাঝে অধিকতর সমান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তুচ্ছাতিতুচ্ছ মডেল করোনা ভাইরাস তার থাবা বিস্তারে প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার বিভেদ করেনি, ঘাতক হয়ে দেখা দিয়েছে পুঁজিপতি, আমলা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, মুটেমুজুর- সবার জন্য। ভিআইপি মান্য করেনি, বৃহৎ সঞ্চয়, এয়ারলিফট, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর কোনো কিছুকেই গ্রাহ্য করেনি- ফুসফুস অকেজো করে দিয়ে পাশের জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। বাংলাদেশের জন্যও বাস্তবতা হচ্ছে ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর বস্তিগুলোতে যেমন করোনা ভাইরাস সংক্রমণে যেমন মৃত্যু গণনা করার কথা, বাস্তবে তা ঘটেনি। দেশের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা গবেষকরা মনে করেন বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে, তা-ই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী হয়েছে। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ সম্ভবত আমেরিকার বেলায় সত্য নয়। আমেরিকার কালো মানুষেরা আমাদের বস্তিবাসীর চেয়ে ভালো জীবনযাপন করলেও সেখানকার সাদাদের তুলনায় শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান আহারসহ সব সূচকেই পিছিয়ে আছে। আমেরিকান মিশিগান অঙ্গরাজ্যে ১৪ ভাগ মানুষ কালো ৮৬ ভাগ সাদা; কিন্তু যখন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটল দেখা গেল আক্রান্তের ৩৩ ভাগেরও বেশি কালো মানুষ আর মোট মৃত্যুর চল্লিশ ভাগ তারাই। অনেকেই এর জন্য দায়ী করছেন বর্ণবাদ এবং বর্ণবাদী প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুনকে। আবার দারিদ্র্য ও পাশ্চাৎপদতার সূত্রও অকার্যকর হয়ে পড়ে ম্যারিল্যান্ডের জর্জেস কাউন্টিতে। সেখানে কালোরাই সবচেয়ে ধনী, উন্নত জীবন তাদের। তারপরও জনসংখ্যার বিচারে সাদাদের তুলনায় তাদের সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই বেশি। আবার আফ্রিকায় বসবাসকারী কালো মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে আমেরিকা বা ইউরোপের সাদারা অনেক বেশি বিপদাপন্ন। করোনা ভাইরাস মানুষের অধিত জ্ঞান উলটপালট করে দিয়েছে। প্লেগে ব্রিটেনের কোনো কোনো অঞ্চলে ১০০ রোগীর ৮০ জনই মৃত্যুবরণ করত। আশার কথা করোনা ভাইরাসের মৃত্যুহার অনেক কম। সচেতনতা ও স্বাস্থ্য খাতে সততার কারণে ভিয়েতনামে এই ঘাতক বিশ^ব্যাধিতে একজন মানুষের মৃত্যু হয়নি। আমরা কেমন, মৃতের সংখ্যাই তা বলে দেবে।

চেয়ারম্যানের স্ত্রী-কন্যা-ভগ্নি যুগপৎ অ্যান্ড্রয়েড ও করোনাযুগে একটি কি দুটি বিব্রতকর পোস্টিং আমরা অনেকেই পেয়ে আসছি। সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক আমার একজন বন্ধু যা পাঠিয়েছেন তা অভ্র নামের কারো সৃষ্টি করা। কালো প্রেক্ষাপটে টাইটানিক খ্যাত লিওনার্দো দ্য ক্যাপ্রিরও ছবি। তার মাথার উপরে-নিচে মিলিয়ে লেখা : সরকার যদি ঘোষণা দেয় পতিতাদের ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে তাহলে ৫০% জনপ্রতিনিধি তাদের বোন-বউ-মেয়েরও নামও সেই পতিতা তালিকায় তুলে দেবে। কোনো সন্দেহ নেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই ভয়াবহ দুর্যোগে প্রান্তবর্তী মানুষ হিসেবে বাণিজ্যিক যৌনকর্মী সবচেয়ে বিপন্ন মানুষের দলে চলে গেছে। দৌলতদিয়ায় নগদ অর্থ ও চাল সরবরাহ করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনেক কিছুই নেই, সম্ভোগের জন্য সামাজিক ভারসাম্যের বাণিজ্যিক যৌনকর্মীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও তাদের তালিকা ও তথ্যের ডাটাবেইজ সম্ভবত নেই। আলজাজিরা টেলিভিশন তাদের অভুক্তদশা নিয়ে সংবাদ দেখিয়েছে। করোনাকালে সরকারের হাত থেকে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে নগদ অর্থ ও ত্রাণ বিতরণের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই নিজেদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নামও তালিকায় সংযুক্ত করেছেন। তালিকার দুর্নীতি এবং জনপ্রতিনিধির প্রতিনিধিত্ব বাতিলের এত সংবাদ পড়ে এটাই মনে হবার কথা পতিতা সহায়তা তহবিল করা হলে জনপ্রতিনিধির স্ত্রী কন্যা ও ভগ্নির নাম পতিতার ঘরে বসাতে জনপ্রতিনিধি এতটুকুও পিছপা হবেন না। চলতি বাজেটে ৫০ লাখ বিপন্ন মানুষ নগদ অর্থ সহায়তা পাবে- এই গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই? ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে বলে মচ্ছব কম করিনি, ফেনা উঠেছে মুখে। বহু বছর আগে থাইল্যান্ডের তখনকার প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার রাজনৈতিক দলটির একটি ডাটাবেইস সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল, দেশের প্রতিটি মানুষের বিবরণী তাতে আছে, বাটনের এক টিপেই সব স্ক্রিনে চলে আসে। আমাদের ডিজিটাল ডাটাবেইসে কি কেবল বণ্টনকারী চেয়ারম্যানের নাম আছে? জনগণ তাতে নেই। আছে মৃত মানুষ, আছে ধনবান প্রবাসীও ওএমএসের তালিকায়।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App