×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালীন গৃহবাস ও সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির কড়চা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২০, ০৬:১৬ পিএম

উদ্ভাবিত এই কলাকৌশল বা অভ্যাস রপ্ত করার মধ্য দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্রটাকে বদলে ফেলতে হবে। আমাদের জীবনাচরণে ইতোমধ্যে সেই পরিবর্তন শুরুও হয়ে গেছে। সাম্প্রতিকের যাপিত জীবনের এসব নিত্যনতুন অভ্যাস নবতর এক সংস্কৃতিও যেন বিনির্মাণ করে চলেছে।

‘বিশ্ববিধির একটা নিয়ম এই দেখিতেছি যে, যেটা আসন্ন, যেটা উপস্থিত, তাহাকে সে খর্ব করিতে দেয় না। তাহাকে এ কথা জানিতে দেয় না যে, সে একটা সোপানপরম্পরার অঙ্গ। তাহাকে বুঝাইয়া দেয় যে, সে আপনাতে আপনি পর্যাপ্ত’ (আত্মপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ)। এ কথাগুলো বর্তমান বৈশ্বিক দুর্যোগকালে প্রকারান্তরে হয়তো বা কিছুটা ভিন্নভাবে হলেও খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বলছি কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রসঙ্গে। এই দুর্যোগ তার স্বীয় ভয়াবহতা নিয়ে মানবসভ্যতার সম্মুখে আসন্ন, উপস্থিত। তাকে এখন পর্যন্ত কেউ পরাস্ত করতে পারেনি। বিশ্বের অপরাজেয় পরাশক্তিগুলোই বরং এই অণুজীবটির কাছে কেমন যেন পরাস্ত ও অসহায়! ইতোমধ্যে মাত্র কয়েক মাসেই সোয়া ৫ লক্ষাধিক মানুষ এই ভাইরাসজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন আর আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে গত সপ্তাহেই। করোনার মতো আগ্রাসী রোগ সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। এর প্রতিষেধক ও প্রতিকার চিন্তায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টা যেমন চলছে, তেমনি এই ভাইরাসটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে বারবার। ইতোমধ্যে হাজারেরও অধিকবার এর ‘জেনম সিকোয়েন্স’ পরিবর্তিত হয়েছে। কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার বিলম্বিত হওয়ার এটিও একটি কারণ। তবে করোনার ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু কলাকৌশল উদ্ভাবনে চিকিৎসাবিজ্ঞান সক্ষম হয়েছে। এই কলাকৌশল আসলে ব্যক্তিগত জীবনাচারণের অতিরিক্ত কিছুই নয়। অর্থাৎ মানুষ তার কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন এবং নতুন কিছু অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। উদ্ভাবিত এই কলাকৌশল বা অভ্যাস রপ্ত করার মধ্য দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্রটাকে বদলে ফেলতে হবে। আমাদের জীবনাচরণে ইতোমধ্যে সেই পরিবর্তন শুরুও হয়ে গেছে। সাম্প্রতিকের যাপিত জীবনের এসব নিত্যনতুন অভ্যাস নবতর এক সংস্কৃতিও যেন বিনির্মাণ করে চলেছে। করোনা-উত্তর সময়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে নতুনরূপে বিনির্মিত এই সংস্কৃতিকেই অবলম্বন করতে হবে। করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছে। এই পরিবর্তন এসেছে জীবনের ‘ভেতর ও বাহির’ উভয় মহলেই। পরিবর্তন এসেছে দেহ ও মনে। অর্থাৎ মানসিকভাবে পরিবর্তনের পাশাপাশি করোনা পরিবর্তন এনেছে দৈহিক অভ্যাসেরও। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে এখন আর হাঁটা যায় না, হাতে হাত মিলিয়ে অভ্যর্থনা করা যায় না, কোলাকুলি আরো কঠিনভাবে নিষিদ্ধ! নামাজে ঘন হয়ে পাশের জনের সঙ্গে শারীরিক স্পর্শ রেখে দাঁড়ানোর বিধান করোনা তার দুর্দাণ্ড প্রতাপে নস্যাৎ করে দিয়েছে। এ রকম আরো কত কি! ‘গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে’- কবিতার চরণ দুটি ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিধানের কাছে কত অসহায় হয়ে পড়েছে তা কল্পনাও করা যায় না! মানসিকভাবে কত অসহায় হয়ে পড়েছি আমরা! এই আমারই যে মনটা সর্বদা কেবল বাইরে যাই যাই করত সেই মনটাই ভয়ার্তচিত্তে এখন ‘বাহিরবিমুখ’- কোনো কাজের অজুহাতেই বাইরে যাওয়া যায় না। বাহিরমুখী আমাদের উড়–উড়– মনকে ভেতরকার আরেকটি স্থির ও শান্ত মনই আবার ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দেয় এখন বাইরে যাওয়া নয়- আরো কিছু দিন ঘরে থাক। এক ধরনের প্রবোধও আসে ভেতর মহল থেকেই ‘সামাজিক দূরত্ব’ ঘুচিয়ে ফেল না এখনই। বাইরে বেরুবার সময় এখনো হয়নি। অর্থাৎ ভেতরকার আমাকে আমিই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি- না, এখনই বাইরে নয় ঘরেই থাকতে হবে আরো কিছুদিন। ঘরেই বসে থাকছি। কিন্তু যে যাই বলুক চিরদিনের অভ্যস্ততা পরিহার খুবই কঠিন! বাইরে বেরিয়ে পড়তে পারলেই যেন বাঁচি! সুস্থ মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে বসে থাকা কত কঠিন তা এই সংকটকালে উপলব্ধি সম্ভব হলো সবার। বিশ্ববিধির আসন্ন ও উপস্থিত এই দুর্যোগকালে বেশকিছু অভিনব কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ঘরেই বসে থাকছি আমরা। এক রকম বন্দি জীবনের মতোই কাটছে এই গৃহবাস। তবে হ্যাঁ, আমার মতো এমন বন্দিত্ব অনেকেরই। সচেতন যারা তারা সবাই বাইরে থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে ঘরের ভেতরেই স্থিত করে নিয়েছেন নিজেদের। এমন অবস্থায় শারীরিক ও মানসিকভাবে সবাই চেষ্টা করছেন ‘সামাজিক দূরত্ব’ অক্ষুণ্ণ রেখে বসবাসের। ‘বাহির বিশ্ব’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরেই আছি- খাই, দাই, ঘুমাই। সেলফজুড়ে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কোনো কোনো বইয়ের পাতা উল্টাই- শুধু যে উল্টাই তাও নয়। পড়াও হচ্ছে কিছু কিছু- অনেকটা মনোযোগ দিয়েই। ঘুম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলেও কিছু কিছু বই পড়ছি ভালোলাগা নিয়ে। আসলে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়ার জন্য নেপথ্যে থেকে করোনা যেন একটি সুযোগই তৈরি করে দিয়ে গেল! পাশাপাশি কিছু অভ্যাসে আমাদের অভ্যস্তও করে গেল। দৈনন্দিনের জীবনযাত্রায় এই অভ্যাসগুলো আগে অসচেতনভাবে চর্চা করলেও এখন সচেতন ও সতর্কভাবে আমাদের মেনে চলতে হয়- মেনে চলি। বিগত চার মাসে এই অভ্যাসগুলো ক্রমেই যেন আমাদের নিত্যদিনের নতুন সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। নিয়ম করে ব্লিচিং পাউডার কিংবা সেভলন মেশানো পানি দিয়ে প্রতিদিন ঘরের ছিটকিনি, তালা, চাবি, সুইচবোর্ড, দরজার লক/হ্যান্ডেল, টেপের কল, ফ্রিজের হাতল, কমোডের ফ্লাশিং, ল্যাপটপ, চেয়ার, টেবিল, আলমারির হাতল, পায়ের জুতা, হাতের ঘড়ি, কোমরের বেল্ট, মোবাইল ফোন মুছে পরিষ্কার করতে হচ্ছে আমাদের। কিছুক্ষণ পরপর ২০ সেকেন্ড করে হাত ধোয়া এখন সবারই মুখস্থ! এ কাজগুলো পঞ্চাশোর্ধ্ব বছরের বিগত জীবনের কোনো দিন করেছি বলে মনে পড়ে না। করিইনি- সুতরাং মনে পড়ার অবকাশও নেই। কোনো দিন কেউ কি কখনো ভেবেছিল বাজার থেকে কাঁচা শাক-সবজি আনার পর ভিনেগার বা খাওয়ার সোডা দিয়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে পরিষ্কারের পর রান্না করতে হবে? কেউ ভাবেনি আগে। কিন্তু এখন এসবই নিত্যদিনের নিয়মিত কর্মসূচির অঙ্গরূপে পালিত হয়ে আসছে। জীবনযাপনের অনুষঙ্গে এই নবতর সংস্কৃতির চর্চা করোনার আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে বলে আপাতত জানা গেছে। নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এই অভ্যস্ত জীবনের নতুন সংস্কৃতি থেকে আমাদের মুক্তি নেই। করোনার ভয়ে ভীত হয়ে আমরা যখন নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে অভ্যস্ততার উপায় খুঁজছি তখনো আমরা আবারো কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো অপসংস্কৃতির সর্বগ্রাসী ছোবলে জর্জরিতও হচ্ছি। ভয়ঙ্কর এই করোনাকে উপলক্ষ করেই এক শ্রেণির মানুষ ‘পয়সা’ বানানোর লক্ষ্যে মেতে উঠেছেন! আমরা এক ভয়াবহ বিপদ ও বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। একে তো ভয়ঙ্কর করোনার আতঙ্ক তার ওপর এই সর্বগ্রাসী আতঙ্ককে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের খপ্পর! আমরা বিপদ থেকে ক্রমাগত বিপদের মধ্যেই আপতিত হচ্ছি। এসব ব্যবসায়ী অর্থ উপার্জনের জন্য বেছে নিয়েছেন অসৎ পন্থা। তারা নানা নামের লেবেল এঁটে বাজারজাত করছেন করোনাজনিত চিকিৎসা সামগ্রী স্যানিটাইজার ও ফেস মাস্ক প্রভৃতি। এসব স্যানিটাইজার বা মাস্কের বাস্তবসম্মত কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ নেই। থাকার প্রশ্নও নেই। কারণ সরকারি চাহিদা মেটানোর জন্য ক্রয়কৃত মাস্কই ইতোপূর্বেও নকলের অভিযোগে কলঙ্কিত হয়েছে। আমাদের চিন্তার জগৎকেও কলুষিত করেছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব দ্রব্যসামগ্রী আমরা নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে পারতাম সেসবের মধ্যে এখন অনুপ্রবেশ করেছে সন্দেহপ্রবণতার তীর্যক প্রশ্ন। দোকানপাট, রাস্তাঘাট, হাটবাজারের সর্বত্রই চিকিৎসা সামগ্রী হিসেবে ফেস মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের রমরমা অবস্থা। এই অবস্থা করোনার ভয়াবহতা কমাতে আদৌ কোনো ভ‚মিকা রাখবে কিনা সে বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে। ‘বিপুল পরিমাণ নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের’ খবর এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। করোনাকে সামনে রেখে যে যেভাবে পারছে ‘পয়সা’ কামিয়ে নিতে পিছপা হচ্ছে না কোনো মতেই। শুধু কি তাই? বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে করোনার ‘নেগেটিভ সার্টিফিকেট’ বিতরণও ব্যবসায়ের অন্তর্গত হয়ে গেছে। মাত্র ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে এই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়! কী অদ্ভুত ও বিচিত্র এই দেশ আমাদের! কী বিচিত্র উপায়ে মানুষ ‘পয়সা’র পেছনে ছুটছে! সাধারণকে ভুল বুঝিয়ে বোকা বানিয়ে ধোঁকা দিয়ে এক শ্রেণির মানুষ সম্পদের ‘পাহাড়’ বানাচ্ছে। এই পয়সাওয়ালারা তাদের এমন রোজগারের পয়সা কোথায় রাখবেন? যদি তারাও কোনো না কোনোভাবে করোনাক্রান্ত হয়ে (আল্লাহ না করুন) মৃত্যুবরণ করেন তবে তা কী কাজেই বা আসবে? কোনোরকম মহামারি বা মানবিক দুর্যোগকে অবলম্বন করে মধ্যযুগেও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এরূপ প্রবণতা দেখা যেত। কিন্তু সভ্যতার এই চ‚ড়ান্ত বিকাশের পরও মানুষের মধ্যে সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা প্রত্যক্ষ করতে হবে তা ভাবা যায় না। ভাবা যায় না বললেই কি আর ভাবনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়। আমাদের ভাবতেই হচ্ছে কিছুসংখ্যক সাধু ব্যবসায়ীর অসৎ পন্থায় পয়সা উপার্জনের ধান্ধা দেখে- বিশেষত বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত মহামারির এই ক্রান্তিলগ্নে। তাই ভাবি আর বিস্ময়ে হতচকিত হই।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App