×

অর্থনীতি

ঋণখেলাপির পোয়াবারো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২০, ০৯:২৩ এএম

ঋণখেলাপির পোয়াবারো

ব্যাংক/প্রতীকী ছবি।

করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত চরম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা আছেন বেশ নিশ্চিন্ত। কেননা, করোনা তাণ্ডবে বিধ্বস্ত উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দিতে চলতি বছরের প্রথম থেকেই বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাতে তাদের হয়েছে পোয়াবারো। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করলেও আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাউকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হবে না। করোনায় নতুন করে খেলাপি না করার এ নিয়মে সর্বশেষ হিসাবে ‘কাগজে-কলমে’ কমে গেছে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। অথচ করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই খেলাপি ঋণের ভারে বিধ্বস্ত ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। ছিল মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতি, তারল্য সংকটসহ বহুমুখী সমস্যা। এ পরিস্থিতিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। কিন্তু করোনার এই সময়ে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে দেখা যায়নি ব্যাংক মালিকদের এ সংগঠনকে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর প্রকোপে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় ব্যাংকিং খাত সংকটে পড়েছে। আগামীতে এ সংকট আরো প্রকট হতে পারে। সম্ভাব্য সংকট থেকে ব্যাংকিং খাতের উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থনীতিকে সচল করে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের সংকট মোকাবিলা করা হবে। প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বলা হয়, দেশে ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ৫ ব্যাংকের কাছেই রয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৫৫ ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ১০ ব্যাংকের কাছেই খেলাপি ঋণ রয়েছে ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ। বাকি ৫০ ব্যাংকে খেলাপির হার ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বড় একটি অংশ পুনঃতফসিল হয়েছে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেয়েছে ঋণখেলাপিরা। ২০১৯ সালের ১৬ মে নীতিমালায় এ ছাড় দেয়ার পর থেকে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল হয়েছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছর পুনঃতফসিল হয়েছে ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করেছে ৩০ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি ব্যাংক ১৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলো ৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এছাড়া গত মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে এই অর্থ বাদ যাবে, যদিও তা আর ফেরত আসছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক তথ্যে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসাবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিতরণ করা ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল খেলাপি। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। সেহিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অথচ গত এক বছরে প্রকৃতপক্ষে কোনো খেলাপি ঋণ আদায় হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাত এখন নানামুখী চাপে। করোনার কারণে এ চাপ বাড়ছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পুরনো সংকট তো রয়েছেই। খেলাপি ঋণের বিপরীতে অনেক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এতে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। ব্যাংকগুলোর উচিত খেলাপি ঋণ যেন না বাড়ে এজন্য নিয়ম-নীতি মেনে ঋণ বিতরণ করা। করোনা সংকটকালে ঋণগ্রহীতাদের বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে সরকার, আগে থেকে যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তারাও এ সুবিধা পাচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলোÑ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া গ্রাহকরা কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন নির্দেশনা জারি করেছিল গত ১৮ মার্চ। ওই সময় বলা হয়েছিল, ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো গ্রাহক কিস্তি পরিশোধ না করলেও তার ঋণমান খারাপ হবে না। তবে কোনো ঋণখেলাপি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করলে তার ঋণমান উন্নত করা যাবে। পরে এ নির্দেশনার মেয়াদ আরো ৩ মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিস্থিতির বিচারে ঋণখেলাপি না করার নির্দেশনার সময়সীমা আরো ৩ মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি হলে চলতি বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দেয়ায় রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। তার ধারাবাহিকতা চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও ছিল। এ দুই মাসেও কিছু ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। তাছাড়া সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি হওয়ার পথও বন্ধ। তার মানে আগামী ৩ মাসেও কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মহামারি সংকট দেখিয়ে পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এজন্য উদ্যোগী হয়েছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকাস (বিএবি)। কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কর্তনসহ ব্যয় কমাতে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এরই মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে অন্তত ৩টি ব্যাংক। যদিও খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে দেখা যায়নি বিএবিকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App