×

সাহিত্য

মাত্রাতিরিক্ত লোভ ও ভোগের লাগাম টেনে ধরুন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২০, ০৭:৫১ পিএম

মাত্রাতিরিক্ত লোভ ও ভোগের লাগাম টেনে ধরুন

মিনার মনসুর

মাত্রাতিরিক্ত লোভ ও ভোগের লাগাম টেনে ধরুন

মিনার মনসুর

বিশেষ সাক্ষাৎকার মিনার মনসুর কবি ও গবেষক
মিনার মনসুর। কবি। অক্লান্ত এক পরিব্রাজক ছাড়া আর কী-ই-বা বলা যেতে পারে আজন্ম নিঃসঙ্গ দলছুট এই কবিকে! তবে শক্তিমত্তায় তার অবস্থান সম্মুখসারিতেই। মূলত কবি হলেও গদ্যেও দ্যুতিময় তার কলম। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সাংবাদিক হিসেবেও সুখ্যাতি রয়েছে তার। সম্পাদক, প্রকাশক ও সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পঁচাত্তর পরবর্তীকালে। প্রতিবাদী লিটলম্যাগ ‘এপিটাফ’-এর অন্যতম সম্পাদক তিনি। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তার প্রধান পরিচয় তিনি কবিই। তার কবিতা নিছক ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, নয় দীর্ঘশ্বাসকণ্টকিত আত্মজীবনীর খসড়াও। গভীর একাগ্রতায় তিনি তার নিরাবয়ব সময়কে দেখেন, দেখেন যুধ্যমান পরিপার্শ্বকে, যার লাটাই অপরিণামদর্শী মানুষের হাতে। মুগ্ধ বিস্ময় ও বিহ্বলতা নিয়ে ঘুরে বেড়ান পুরান ও ইতিহাসের জটিল গোলকধাঁধায়। আর অনিবার্যভাবে ফিরে আসেন আরশিনগরের সেই পড়শির কাছে। সর্বসত্তা পেতে তাকে খোঁজেন। মূলত তাকেই খোঁজেন। সেখানে ইতিহাস-দর্শন, সমাজ-সভ্যতা, কাল-মহাকাল সব একাকার হয়ে যায়। মিনার মনসুরের লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। একেবারেই স্বতন্ত্র স্বর- সেটি কী সাহিত্যে কী ব্যক্তিত্বে। নিভৃতচারী হলেও নিরন্তর নিরীক্ষা এবং নিজেকে অতিক্রমণের প্রবল প্রয়াস তাকে করে তুলেছে বাংলা কবিতার বিশিষ্ট এক কণ্ঠস্বর। সহজতা ও সুদূরতা, অস্তিত্ব ও অস্তিত্বহীনতা এবং মৃত্যু ও মৃত্যুহীনতা হাত ধরাধরি করে চলে তার কবিতায়। তবে প্রায়শ সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ ও ধূলিকণার জন্যে অনন্য এক মমত্ববোধ। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিবাদী সাহিত্যধারার অন্যতম পথিকৃৎ। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী প্রথম স্মারক সংকলনগ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৯)-এর অন্যতম সম্পাদক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ সামরিকজান্তা কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। গদ্যপদ্য মিলিয়ে প্রকাশিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০। বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক তিনি। বিশিষ্ট এই কবি করোনাকাল কেমন কাটছে জানতে ভোরের কাগজের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সত্যি বলি, ভয়ের মধ্যে আছি। ভয় নিজের জন্যে যতটা নয়, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি আমাদের চেনা পৃথিবীটার জন্যে, প্রিয় মানুষগুলোর জন্যে। দেখুন, একেবারে শুরু থেকে কেন জানি না আমার মনে হয়েছে, আমরা আমাদের চেনা পৃথিবীটাকে সহসা আর ফিরে পাবো না। সেই ভয় বলুন আর ভাবনাই বলুন, মূলত তারই তাড়নায় আমি গত ১৬ মার্চ থেকে ফেসবুকে ‘করোনার সঙ্গে বসবাস’ নামে একটি ব্যক্তিগত নোট লিখতে শুরু করি। এখনো লিখছি। প্রথম লেখাটিতেই আমি বলেছি, এক অদৃষ্টপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে মানবসমগ্র। আমাদের করোনার সঙ্গে বসবাস করা শিখতে হবে। তো মোটামুটি আমার একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। সে অনুযায়ী চলছি। নিয়মিত লিখছি। যত লিখছি, পড়ছি তার দ্বিগুণ। একই সঙ্গে, আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বে আছি। সেই দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছি পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে। নিয়মিত অফিস করছি। এই বিপর্যয়ের মধ্যেও আমরা যথাসময়ে তিনশতাধিক প্রকাশকের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক বই ক্রয় এবং সাত শতাধিক বেসরকারি গ্রন্থাগারে অনুদান প্রদানের কাজ সম্পন্ন করেছি অত্যন্ত সফলভাবে। বলতে পারেন, আমিও একজন ফ্রন্টলাইন করোনাযোদ্ধা। যেকোনো পরিস্থিতির জন্যে তৈরি আছি। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো, ইনশাল্লাহ। কী লিখছেন? কী বই পড়ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কবি বলেন, গত ১৬ মার্চ থেকে ‘করোনার সঙ্গে বসবাস’ নামে একটি ব্যক্তিগত কলাম লিখে যাচ্ছি দিনপঞ্জির আদলে। ইতোমধ্যে ৫০ কিস্তি লেখা হয়ে গেছে। সেটি অনেকেই পছন্দ করেছেন। কেউ কেউ বই আকারে প্রকাশেরও আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমার ইচ্ছেও অনেকটা তাই। কবিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। বহুদিন ছন্দে লেখা হয় না। এ সুযোগে নানা ছন্দে বেশকিছু কবিতা লিখেছি। পাশাপাশি স্মৃতিকথা লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রচুর বই পড়ছি। তার মধ্যে কোনো কোনো বই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো পড়ছি। যেমন- টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘আত্মজৈবনিক’। এছাড়াও পড়েছি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ‘আমার কথা’ এবং আল মাহমুদের ‘কবির মুখ’। এখন পড়ছি শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’।
করোনার অভিঘাতে আপনার চেনা পৃথিবীর কতোটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন? জবাবে মিনার মনসুর বলেন, আমার একার নয়, মানবসমগ্রের পৃথিবীই অনেকটা বদলে গেছে ইতোমধ্যে। বদলে গেছে জীবনাচরণ। আরও বদলাবে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, মানুষের মধ্যে অনুশোচনা ও আত্মসমালোচনার একটি প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাদের মধ্যে শুভবোধ ও শুভবুদ্ধি জাগ্রত হবে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বরং ভিন্ন কথাই বলছে। আমার ধারণা, করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তারা হয়ে উঠবে আরও আত্মকেন্দ্রিক, অসহিষ্ণু ও মারমুখী। বিশেষ করে শিশুকিশোরদের নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত। অনির্দিষ্টকালের এ গৃহবন্দিত্ব তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারে।
[caption id="attachment_229808" align="aligncenter" width="2100"] মিনার মনসুর[/caption] করোনার এই সময়টাকে কেউ বলছেন একাত্তরের মতোই যুদ্ধ চলছে দেশে, আপনার কী মনে হয়? তিনি বলেন, আমি তা মনে করি না। দুটো একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধ একটা বোধগম্য ও দৃশ্যমান বাস্তবতা। আমরা শত্রুমিত্র চিনতাম। জানতাম শত্রুকে পরাস্ত করার কৌশলও। সর্বোপরি, তা সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের মানচিত্রের মধ্যে। বাকি পৃথিবীটার মাথা সুস্থির ছিল। কিন্তু এখন, মহাশক্তিধর আমেরিকা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনপদ পর্যন্ত কারো নিস্তার নেই। কেউ জানে না কী করতে হবে। একদিকে অদৃশ্য দানবটির তাণ্ডব, অন্যদিকে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। সবারই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ফলে কেউ কারো দিকে যে সহযোগিতার হাত বাড়াবে সেই অবস্থাও নেই। এটা একেবারেই ভিন্ন ধরনের এক বাস্তবতা। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। বাংলাদেশ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয়? এই গবেষক বলেন, যদি সমস্যাটা বাংলাদেশের একার হতো তাহলে আমি হয়তো আবেগের বশে বলে ফেলতাম, পারবে। পারতেই হবে। কিন্তু সারা পৃথিবীই যেখানে আক্রান্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে আমরা একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। আমাদের আয়ের একটা বড় উৎস রেমিট্যান্স। এখন আমাদের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক যদি কাজই করতে না পারে, রেমিট্যান্স আসবে কোত্থেকে। একইভাবে, আমাদের অর্থনীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাতটি হলো, পোশাকশিল্প। পোশাক যারা কিনবে তারাই যদি ডুবে যায়, তাহলে আমরা দাঁড়িয়ে থাকবো কীভাবে? অতএব, এ মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন। শুধু এটুকু বলা যায় যে আমরা এখনো অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালো আছি। প্রকৃতির প্রতি যথেচ্ছাচারের কারণেই প্রকৃতি এতো মানববিধ্বংসী হয়ে উঠেছে? আপনার কী মনে হয়? তিনি বলেন, সীমালঙ্ঘনের পরিণতি কখনো ভালো হয় না। এটা আমাদের ধর্মেও আছে। মানুষ যে সব ধরনের সীমা লঙ্ঘন করে গেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রকৃতি যতই সর্বংসহা হোক, তাকে তার সহ্যসীমার বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে বহু আগেই। এ বিপর্যয় যে এক অর্থে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত লোভ, বাড়াবাড়ি ও ভোগবাদিতারই পরিণাম তাতে সন্দেহ নেই। মিনার মনসুর বলেন, স্বদেশবাসীর জন্যে তিনটি পরামর্শ: প্রথমত ধৈর্য, দ্বিতীয়ত ধৈর্য এবং তৃতীয়ত ধৈর্য। ধৈর্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন দয়া করে। নয়তো বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। মানবসমগ্রের জন্যে একটাই পরামর্শ: এখনো সময় আছে মাত্রাতিরিক্ত লোভের ও ভোগের লাগাম টেনে ধরুন। প্রকৃতিমাতার প্রতি সদয় হোন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App