×

জাতীয়

বন্যার সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২০, ১০:৪০ এএম

বন্যার সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ

গাইবান্ধা-বালাসীঘাট সড়কের কঞ্চিপাড়ায় প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ব্রহ্মপুত্রের পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন জনগণ। প্রতিদিন এ পথে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করলেও নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই। গতকালের ছবি

দেশের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় বন্যার্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। এরমধ্যে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় এখন পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৬৪ সে.মি. ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৩১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এদিকে পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়তে থাকায় মাদারীপুরের শিবচরের চরাঞ্চলের ৩ ইউনিয়নে নদীভাঙনের ব্যাপকতা বেড়েছে। অপরদিকে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ কমাতে জামালপুর জেলা প্রশাসন ত্রাণ বিতরণ শুরু করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে দাবি জনপ্রতিনিধিদের। ফরিদপুরের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। জেলার তিন উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ৫০টি গ্রামে পদ্মার পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। নিচে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর গাইবান্ধা : জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ২৫৫টি চরের অধিকাংশ এলাকায় এখন পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নারীরা বেশি সমস্যায় রয়েছেন। বাঁধে আশ্রিত বানভাসি মানুষের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে টিউবওয়েল স্থাপন ও অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণের দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৬৪ সে.মি. ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৩১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে শুক্রবার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সেখানে হুমকিতে রয়েছে আশপাশের দুই শতাধিক বসতবাড়ি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, হলদিয়া ইউনিয়নে ভাঙন এলাকায় অস্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করার জন্য শুক্রবার ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। জামালপুর : যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করলেও কমছে না বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। জেলা প্রশাসন বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ কমাতে ত্রাণ বিতরণ শুরু করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নেই বলে দাবি করছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে ত্রাণ বিতরণ চলছে, আরো ত্রাণের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানান, শুক্রবার সকালে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পার্শবর্তী দেশ ভারতে যদি বন্যা না হয় তবে যমুনার পানি কমতে থাকবে। আর যদি বন্যা হয় তবে তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে। চীনাডুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, তার ইউনিয়নে ৫০ হাজার জনগণের ভেতর ৩৫ হাজার জনগণ পানিবন্দি। তিনি এ পর্যন্ত ১৫ টন ত্রাণ বরাদ্দ পেয়েছেন, যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ত্রাণের বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী জানান, চাহিদার তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ কম হওয়ায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে ৭০০ টন জিআর চাল, নগদ ১৪ লাখ টাকা ও ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এসব পেলে ত্রাণের চাহিদা পূরণ হবে বলে তিনি আশা করছেন। ফরিদপুর : জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়ন, চর ঝাউকান্দা, চর হরিরামপুর ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম, সদরপুর উপজেলার চর নাছিরপুর, চর মানাই, দিয়ারা নারকেলবাড়িয়া, ঢেউখালী, আকুটেরচর ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে এবং ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল, ডিক্রিরচর, চর মাধবদিয়া ও আলিয়াবাদ ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের নিম্নাঞ্চলের পানি প্রবেশ করেছে। ফরিদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীতে ৯.০৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলায় মধুমতি নদীতে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জানান, সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। অন্যদিকে ভাঙনকবলিত এলাকায় প্রাথমিকভাবে ভাঙনরোধে কাজ করার জন্য পাউবোকে বলা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ : শুক্রবার সকাল থেকে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৬ এবং কাজিপুর পয়েন্টে ৬৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পাঁচ উপজেলার প্রায় ৩৩টি ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রামের ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তলিয়ে গেছে প্রায় ৩৫৬৫ হেক্টর জমির ফসল। অপরদিকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পানিবন্দি মানুষ বিভিন্ন বাঁধের উপর আশ্রয় নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিরাজগঞ্জের উপসহকারী প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানা গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, জেলার পাঁচ উপজেলার ৩৩ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ২১৬টি গ্রামের ৩৪ হাজার ৬৮৪টি পরিবারের ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি ধীরে ধীরে কমলেও ধরলা নদীর পানি আবারো বাড়তে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। শুক্রবার সকালে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৯টি গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। প্রায় ১৬ হাজার ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৫ শতাধিক পরিবার। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। গত দুদিন ধরে ভারি বর্ষণের কারণে সড়ক ও বাঁধের উপর আশ্রিত মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট আরো প্রকট হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, চাহিদামতো বরাদ্দ না পাওয়ায় এখনো সব বন্যার্ত মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া সম্ভব হয়নি। টাঙ্গাইল : টানা দুদিন যমুনার পানি কমলেও গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আবার ৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও জেলার ঝিনাই নদীর পানি বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ও ধলেশ্বরী নদীর পানি ৮৮ সেন্টিমিটার উপরে রয়েছে। ফলে নদী তীর উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ধলেশ্বরীসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, দেলদুয়ার, ভ‚ঞাপুর, কালিহাতী ও গোপালপুর উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ৯৩টি গ্রামের এক লাখ ২৪ হাজার ৫৭১ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারসহ গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ১ হাজার ১৮৯টি ঘরবাড়ি। পানি বৃদ্ধির ফলে যমুনা নদী রক্ষা বাঁধের পূর্ব তীরের ভ‚ঞাপুরের গাড়াবাড়ী এলাকায় লিকেজ দেখা দেয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাঁধটি। বন্যাকবলিতদের অভিযোগ, পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাননি তারা। বন্যায় টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার, ঝিনাই নদীর পানি ৪৯ সেন্টিমিটার ও ধলেশ্বরী নদীর পানি ৮৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও জেলার অন্য সব নদীর পানিও বাড়ছে। এতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। শিবচর (মাদারীপুর) : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে শিবচরের চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নে নদীভাঙনের ব্যাপকতা বেড়েছে। ১২০টির বেশি ঘরবাড়ি অন্যত্র কোনোমতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে একাধিক স্কুল ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জানা যায়, গত কয়েক দিন ধরে পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিবচরের চরাঞ্চলের চর জানাজাত, কাঁঠালবাড়ী, বন্দরখোলায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীতে বিলীন হয়েছে বন্দরখোলার অস্থায়ী বাঁধের একাংশ। ৩টি ইউনিয়নের অন্তত ১২০টি ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কাঁঠালবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মোহসেনউদ্দিন সোহেল বেপারি বলেন, পদ্মার ভাঙনে আমার ইউনিয়নের চরচান্দ্রা এলাকার অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি আক্রান্ত হওয়ায় অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও চর জানাজাত ও বন্দরখোলা ইউনিয়নেও ব্যাপক ভাঙছে। শিবচর সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) এম রকিবুল হাসান বলেন, নদীভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয় সংসদ সদস্য চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর নির্দেশে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App