×

সারাদেশ

শ্রমিকদের পরিবারে নীরব কান্নার আহাজারি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২০, ১২:১৯ পিএম

শ্রমিকদের পরিবারে নীরব কান্নার আহাজারি

খুলনার দৌলতপুর জুটমিলে টানানো নটিশ দেখে শ্রমিকদের হতাশা

রাষ্টায়ত্ব ২৫টি পাটকল অবশেষে বন্ধসহ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসায়ন ঘোষণা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) রাতে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন এ মিলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটি সব মিলের নোটিস বোর্ডে টানিয়ে শ্রমিকদের অবহিত করা হয়েছে।

এর আগে গত কয়েকদিন ধরে খুলনা শিল্পাঞ্চল এলাকায় ব্যাপক পুলিশ মোতায়ন করা হয়। তবে কবে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে- তা এই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি। একদিকে মিল বন্ধ অন্যদিকে ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহ ধরে মজুরি বকেয়া থাকায় শ্রমিকদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের পরিবারে চলছে নীরব কান্নার আহাজারি। আগামীকাল শনিবার রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে।

এর আগে গত ২৫ জুন রাষ্ট্রায়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মিল বন্ধ ঘোষণার পরই শ্রমিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ গত ২৮ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যেমে ২ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করে। অবস্থান, বিক্ষোভ, সমাবেশসহ শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে শ্রমিক পরিবারে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানরাও অংশ নেয়। শ্রমিকদের বুক ফাটা স্লোগানে গোটা শিল্পাঞ্চল এলাকা ভারী হয়ে ওঠে।

দুদিনের মধ্যে মিল বন্ধের নোটিস না দেয়ায় শ্রমিক নেতারা অনশনসহ সব কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে। এরই মধ্যে খালিশপুর পিপলস গোল চত্বর, দৌলতপুর জুট মিল গেট, আটরা ইস্টার্ন মিল গেট ও নওয়াপাড়া শিল্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়। পাটকল বন্ধসহ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসায়নের প্রজ্ঞাপন বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় প্রথমে প্লাটিনাম, রাত পৌনে ৯টায় ক্রিসেন্ট, এরপর পরই খালিশপুর, দৌলতপুর, দিঘলিয়ার স্টার, আটরা শিল্প এলাকার ইস্টার্ন ও নওয়াপাড়া শিল্প এলাকার কার্পেটিং জেজেআই জুট মিলের নোটিস বোর্ডে টানিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে, মিল বন্ধের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিক স্ব স্ব মিল গেটে সমবেত হয়। প্রজ্ঞাপন পড়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শ্রমিকদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে শিল্পাঞ্চলের আকাশ বাতাস। রাত ১০টায় মিলের শেষ হুইসেল শুনে শ্রমিকরা গেট ত্যাগ করেন।

শ্রমিকরা জানান, ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহ পর্যন্ত মজুরি ও কর্মকর্তা-কর্মচরীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। বকেয়া মজুরি না পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে থাকতে হবে। এই দুই মাস কীভাবে চলবো, ছেলে-মেয়েদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেব। এখন মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় নেই। হঠাৎ করে মিলটির উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে শ্রমিকরা। শুক্রবার ভোর থেকেই অনেকে মিল এলাকা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়ি যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অস্থায়ীভাবে কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, মিল বন্ধ হওয়ায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কোনো সুবিধাই পাবোনা। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরতে হবে শূন্য হাতে ।

রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল হামিদ সরদার বলেন, আমরা এখন অসহায়। এই পরিস্থিতিতে এককালীন শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ ও পুণরায় মিলগুলো চালানোর জন্য সরকাররে কাছে দাবি জানান। আগামীকাল শনিবার সকালে খালিশপুর প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস এমপ্লায়িজ ইউনিয়নে রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রক্ষা সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান আব্দুল হামিদ।

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনেন বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বনিজ উদ্দীন মিয়া জানান, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে পাঠানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিজেএমসির সচিব এএফএম এহতেশামূল হক স্ব স্ব মিলের প্রকল্প প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক ১ জুলাই থেকে ২৫টি পাটকলের শ্রমিকদের অবস্থানসহ মিলে উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বনিজ উদ্দীন মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে খুলনা অঞ্চলের ৯টি পাটকলের মধ্যে ৮টি মিলের স্ব স্ব নোটিস বোর্ডে এ প্রজ্ঞাপন টানিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মিলের সাইরেন বন্ধ থাকবে।

পাট মন্ত্রণালয় সচিব স্বাক্ষরিত গত ৩০ জুন প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি পাটকলের শ্রমিকদের চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধার আওতায় অবসানসহ উৎপাদন কার্যক্রম ১ জুলাই থেকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তবে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইনের ২০০৬ এর সংশ্লিষ্ট ধারার বিধানমতে পরিশোধ করা হবে।

এদিকে পাটকল বন্ধ ও শ্রমিকদের অবসায়নের বিষয় নিয়ে সরকার বেশ কয়েটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী স্বাক্ষরিত দপ্তারাদেশে এই সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, শ্রম আইন ২০০৬ এর উপ-ধারা (৩) অনুযায়ী নোটিস মেয়াদের অর্থাৎ ৬০ দিনের মজুরি, চাকরি বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য গ্রাচ্যুইটি, পিএফ তহবিলে জমা করা সমুদয় অর্থ ও প্রাপ্য গ্রাচ্যুইটির ওপর নির্ধারিত হারে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে সুবিধা প্রদান।

কর্মরত ও অবসরকৃত শ্রমিকদের যাবতীয় পাওনা অনধিক দুই লাখ টাকার ক্ষেত্রে ১০০% নগদে প্রদান করা হবে। ২ লাখ টাকার অধিক পাওনার ক্ষেত্রে ৫০% নগদে ও ৫০% তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট হতে যথাশিগগিরই সম্ভব পরিশোধ করা হবে। নগদে পরিশোধ্য পাওনা ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্রের পাওনা সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে নির্ধারিত ব্যাংক/ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। বিজেএমসির অন্যান্য দায় দেনা ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে পরিশোধ করা হবে।

বিজেএমসি ও মিলগুলির স্থাবর/অস্থবর সম্পত্তি, যন্ত্রপাতি, তৈরি পণ্য, কাঁচামালের পরিপূর্ণ তালিকা তৈরি এবং সেগুলো রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে স্থান ও মিল ভিত্তিক পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার পরে প্রতিটি মিলের নিরাপত্তার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ নিরাপত্তা দলের ওপর ন্যস্ত করা হবে। বিজেএমসির অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন মিলের প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ/এমপিওভুক্ত করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা/ শিক্ষা মন্ত্রনালয়কে অনুরোধ জানানো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App