×

মুক্তচিন্তা

বর্ণবৈষম্যের প্রবহমান অন্তর্জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ০৭:২২ পিএম

ভারতের আসামে জাতিদাঙ্গার সময় ভুপেন হাজারিকা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মাইলের পর মাইল পথ গেয়েছেন ‘মানুষ মানুষের জন্য’। গান কালজয়ী হয়েছে, ভুপেন হাজারিকা ভারতের সর্বোত্তম অসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ পেয়েছেন, কিন্তু যে কারণকে সামনে রেখে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমা তা কি আদৌ সফল হয়েছে? আমরা বর্ণবিদ্বেষের জন্য আমেরিকার দিকে আঙুল তুলি কিন্তু বুকে হাত দিয়ে কি বলতে পারি বিশ্বের আর কোনো দেশে বৈষম্য নেই, বর্ণবিদ্বেষ নেই, অসাম্য নেই? প্রতিটি দেশেই কোনো না কোনো ফর্মে এ আদি পাপ আছে। কখনো তা ব্যক্তিপর্যায়ে, কখনো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, কখনো সমাজের ভেতরে, কখনো ধর্ম, ভাষা, সম্প্রদায়ের মোড়কে। আমেরিকাতে যেহেতু এই বর্ণবিদ্বেষ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে তাই এর তীব্রতা বেশি। অন্য দেশ থেকে এক কাঠি সরেস। আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষের উৎস সন্ধান করতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দেড়শ বছর আগে। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ এই চার বছরকাল আমেরিকার ইতিহাসের অস্থির সময়। কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতায়ন আর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকাল। ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে দেশে ক্রীতদাস প্রথার বিলোপ আর সামাজিক ন্যায়ের প্রারম্ভকাল এটা। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন ১ জানুয়ারি ১৮৬৩-তে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে দেশের প্রায় ৩ লাখ ক্রীতদাসকে মুক্ত করেন। কিন্তু ‘এহ বাহ্য আগে কহ আর’ অবস্থা। কারণ সেই সময়ের সেই সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় যে ছয়ের দশকের এই গৃহযুদ্ধে ক্রীতদাস প্রথার সমর্থনকারী সম্মিলিত শক্তি আর দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্যগুলো লিংকনের নেতৃত্বাধীন সমরশক্তির হাতে পরাজিত হলেও ওইসব রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গরা কার্যত অধিকারহীন হয়েই ছিল। এমনকি ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আইন এনেও রাষ্ট্রপতি লিংকন প্রাতিষ্ঠানিক ক্রীতদাস প্রথার উচ্ছেদ হবে না বলে ঘোষণা করেছিলেন। ফলে বুঝাই যায় যে শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন হারানোর আশঙ্কায় একটা অমানবিক প্রথাকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার দুঃসাহস তিনি দেখাতে পারেননি। এরপর প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, জন কেনেডি হয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা অনেকেই সমতা, সাম্য আর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় কমবেশি চেষ্টা করেছেন। গত দেড়শ বছরে মনমানসিকতার যে এক্কেবারেই পরিবর্তন হয়নি তা নয়, কিন্তু এ কথাও সমানভাবে সত্য যে বিগত পাঁচ দশকে আমেরিকাতে যে ৫০ হাজারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবিদ্বেষের জেরে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নির্দোষ ছিলেন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, আমেরিকার স্কুলগুলোতে মোট ছাত্রের মাত্র ১৫ শতাংশ হলো কৃষ্ণাঙ্গ। সে দেশে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারী নিয়োগ করতে আজো ব্যক্তিমালিকানাধীন খণ্ডগুলো মোটেও উদার নয়। রাস্তাঘাটে কেবল সন্দেহের বশে পথ আটকে জেরা করার ক্ষেত্রে পুলিশের চোখে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের অনেক বেশি সন্দেহের আবর্তে রাখা হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের আরো অন্যান্য দেশের পুলিশের মতো আমেরিকান পুলিশের মনেও আগ্রাসী মনোভাব, সংখ্যালঘু পীড়নের আনন্দ, বিজয়ী হিসেবে নিজেদের উৎকৃষ্ট জাতি ভাবার মনস্তত্ত¡ সব কাজ করে। আমেরিকানরা যেমন অভিবাসীদের নানা শ্রুতিকটু নামে ডাকে, আমরাও মঙ্গোলীয় চেহারা হলে পাহাড়ি, চিঙ্কি ইত্যাদি নামে ডাকি। এখন মঙ্গোলীয়দের করোনা বলে ডাকা হয়। কারণ রোগটা চীন থেকে আমদানি। সমতল অঞ্চলে অনেক জায়গায় তাদের দেখলে অহেতুক তাড়া করা হয়, পুলিশ ডেকে সমঝে দেয়া হয়। আসলে রোগ এখানে হাতিয়ার, মূলত এটা বর্ণবৈষম্য। সমানভাবে পাহাড়ের মানুষরা সমতলের মানুষদের ময়ং, বাই ইত্যাদি আরো কত নামেই না ডাকে, সব তো বুঝি না। আমারই এক পরিচিত ভদ্রলোক উত্তর-পূর্ব ভারতের এক পাহাড়ি অঞ্চলে চাকরি করতেন। তার নিজের রাজ্য থেকে যখনই তিনি সে রাজ্যে গিয়ে ঢুকতেন তখন চেক গেটের স্থানীয় পুলিশ বাস থামিয়ে চেক করত। সব যাত্রীর দিকে দেখতে দেখতে পুলিশের চোখ আকছার তার মুখে এসে আটকে যেত। ‘ইউ, ইয়েস ইউ স্ট্যান্ড আপ’ বলে তাকে দাঁড় করিয়ে তল্লাশি চলত। বাসভর্তি যাত্রীর সামনে এ অপমান তাকে বহুবার দগ্ধ করেছে। কেন কেবল তিনিই সন্দেহভাজন তার উত্তর তিনি জানার সাহস করেননি কখনো। একইভাবে চিঙ্কিদের সমতল অঞ্চলে নানাভাবে উত্ত্যক্ত হতে হয়। সরকারকে এসব দমনে কঠোর আইন বানাতে হয়। সবাই হয়তো প্রকাশ্যে এসব করে না, কিন্তু কেউ না কেউ তো করে! তাই শুধু সব দোষের দায় আমেরিকা নামক নন্দ ঘোষের নয়। দেশে দেশে এমন ঘটনা আছে। বৈষম্য ভেদাভেদ বিরোধাভাস আছে। নির্যাতন নিগ্রহ নির্লজ্জতা আছে। কারণ এ মানসিকতা দেশ কালের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বময়। এর শিকড় সমাজের বহু গভীরে। এ পাপ অদম্য, অবিনশ্বর।

কলাম লেখক, উত্তর-পূর্ব ভারত।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App