প্রবাহিকা : প্রবহমান জীবনের আলেখ্য
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ০৮:২৬ পিএম
বন্ধুপ্রতিম প্রশান্ত কুমার লাহিড়ী একজন সুলেখক। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। বয়স আশি-ঊর্ধ্ব। সপরিবারে বসবাস করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে যদিও তিনি জীবন-জীবিকার জন্য পড়ে আছেন, কিন্তু মন তার ঘুরে বেড়ায় কলকাতার অলি-গলিতে। তার লেখার শব্দে শব্দে আছে কলকাতার অনাবিল দৃশ্যপট। দিল্লি, লখনৌসহ অনেক শহরের মনোরম বর্ণনা আছে প্রশান্ত লাহিড়ীর সজীব লেখায়। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘ফিরে আসি দুয়ারে তোমার’ (কবিতা), ‘প্রবাদ সংকলন’, ‘পৃথিবীর এক ঝলক’ (ভ্রমণ কাহিনী)’, ‘মানুষের রং’ (একগুচ্ছ বিদেশি নাটক), ‘ইন্দ্রধনুষ (প্রবন্ধ)’, আমি পড়েছি। পড়ে ভীষণভাবে আবেগতাড়িত হয়েছি। এবার সারা বিশ্ব যখন লকডাইনে বন্দি, তখন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘প্রবাহিকা’ অবশ্য লকডাউনের মধ্যে আমারও একটি কবিতার বই প্রকাশ হওয়ার কথা। ঘরে বসে বসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইটি পড়লাম। পড়ে মনে হলো আশ্চর্য একটি বই পড়লাম। ‘প্রবাহিকা’ বইটিতে ছয়টি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায়ের বিভাজন বইটিকে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম- ‘ছেলেবেলা : সেই পুরোনো কলকাতা’। এই অধ্যায়টি পড়ে আমি যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কলকাতাকে আবার নতুন করে অনুভব করলাম। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কলকাতাতেই ছিলাম। কলকাতার অলি-গলিতে বহুদিন আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। কত অচেনা মানুষ তখন আপন হয়ে উঠেছিল। কত ঘর সেদিন নিজের ঘর বলে ভেবেছি তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। পঁচাত্তরের নির্মম ট্র্যাজেডির পরেও কলকাতায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলাম তিন বছর। সেই তিন বছরের স্মৃতিও আমার জীবনের অমূল্য সঞ্চয়। এখনো চোখ বুজলে আমি আমার সেই ফেলে আসা দিনগুলো অনুভব করতে পারি। প্রশান্ত লাহিড়ীর লেখায় সরলতা উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। তিনি যখন কোনো ঘটনার বর্ণনা দেন, তখন অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সেগুলোকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার প্রয়াস দেখান। উত্তর কলকাতার জীবনযাপনের ছবি তার লেখায় একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উত্তর কলকাতার ‘রক’ কালচার সম্পর্কে আমরা অনেকেই কমবেশি জানি। এই ‘রক’ জিনিসটার প্রকৃত পরিচয়ও পাওয়া যায় ‘প্রবাহিকা’ গ্রন্থ থেকে। ‘রক’ প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন- ‘প্রায় বেশিরভাগ বড় রকমের বাড়ির সামনেই ছিল বাড়ি সংলগ্ন ‘রক’। এই রক জিনিসটা বোধহয় তখন নর্থ-ক্যালকাটার বিশেষত্ব ছিল। এইগুলো ছিল বাড়ির প্রধান দরকার পাশেই খোলা বারান্দার মতো। এর উপরেই দেখা দিত দিনের এক রূপ আর সন্ধ্যের পরে আরেক রূপ। দিনের বেলা এসে বিশ্রাম নিত শ্রান্ত ফেরিওয়ালা, ক্লান্ত ভিখারি, দুপুরে কাজের শেষে একটু বিশ্রামের জন্য আশপাশে বাড়ির চাকর-বাকর। আবার এখানেই দেখেছি ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে পীড়িত অন্নাভাবে ক্লিষ্ট জরাজীর্ণ চেহারার মা কী করুণ কণ্ঠে মিনতি করে ডাকছে ‘মা, এড্ডু ফ্যান দ্যান’। এই রকেই দেখেছিলাম এই দুর্ভিক্ষে মা কোলে ছেলে নিয়ে মরে পড়ে আছে।’ শুধু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করেই লেখক ক্ষান্ত হননি। পরাধীন ভারতবর্ষে কারণে-অকারণে যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো- তাও তিনি দরদি মন নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেসময় কী পরিমাণ প্রাণহানি ঘটিয়েছে সেসবের তথ্যও তিনি যথাসম্ভব উল্লেখ করেছেন। প্রশান্ত লাহিড়ী ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না। মধ্যবিত্ত একটি পরিবারেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার বেড়ে ওঠার মধ্যে একটা সংগ্রাম ছিল। ত্যাগ ছিল, পরিশ্রম ছিল। আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে তিনি কোনো কিছু আড়াল করেননি, কোনো কিছু বাড়িয়ে বলে নিজের অহংকার প্রকাশ করেননি। ‘প্রবাহিকা’ গ্রন্থের পরতে পরতে আছে পরাধীন ও স্বাধীন ভারতের কথা, আছে লেখকের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের উপাখ্যান। প্রশান্ত লাহিড়ীর আত্মজীবনীমূলক এই লেখাটার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটা কারো ব্যক্তিগত কথা না হয়ে প্রত্যেকটি সংগ্রামী মানুষের কথা হয়ে উঠেছে। লকডাউনের মধ্যে এমন একটি সুলিখিত সরস গ্রন্থ পাঠ করে সীমাহীন আনন্দ পেয়েছি। যেমন আনন্দ পেয়েছিলাম তাঁরই লেখা ‘পৃথিবীর এক ঝলক’ ভ্রমণকাহিনী পড়ে।