×

মুক্তচিন্তা

অনিশ্চিতার মুখে জীবন ও জীবিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২০, ০৭:৩২ পিএম

আমাদের সামষ্টিক জীবন এখন চরম ঝুঁকির কবলে, তেমনি জীবিকাও। তবু আমরা আশাবাদী হতে চাই। নিশ্চয় করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে। আমরা স্বাভাবিক জীবন, জীবিকা ফিরে পাব। বিদ্যমান অব্যবস্থা, অনাচার মুক্ত হয়ে নতুন দিনের শুভসূচনায় নতুনভাবে বাঁচব- সেটাই প্রত্যাশিত।

করোনার ক্রমাগত বিস্তারে আমরা অনিশ্চিত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমাদের জীবন যেমন জীবিকাও তেমনি চরম অনিশ্চয়তার মুখে। দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধিতে আমরা যে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছি, তাতে তো আর সন্দেহ নেই। শিক্ষাঙ্গন ছাড়া সবক্ষেত্র খুলে দেয়ার পরও কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেনি। বরং অনিশ্চয়তার শঙ্কা-আতঙ্কে আমাদের জীবন কোনোক্রমে অতিবাহিত হচ্ছে মাত্র। বেঁচে আছি তবে আদৌ করোনা থেকে বাঁচতে পারব কিনা সে নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। দীর্ঘ লকডাউনের পর জীবিকানির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবিকায় ফিরে গেলেও ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ জীবিকা হারিয়েছে। শ্রমিক, কর্মচারী, দোকান কর্মচারী থেকে নানা পেশায় যুক্ত অসংখ্য মানুষ জীবিকা হারিয়ে সম্পূর্ণ বেকার। নানা পেশায় যুক্ত অসংখ্য মানুষ জীবিকার শঙ্কায় এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীদের সেই শঙ্কা নেই। পেশাজীবীদের মধ্যে সংখ্যাধিকেরা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। এছাড়া হকার, দিনমজুরসহ স্বল্পআয়ের মানুষেরা এখন চরম দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে। জীবিকাহারা মানুষের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে, সামনে তো আরো কঠিন সময় আসছে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। আমরা যে ক্রমেই আরো সংকটাপন্ন অবস্থার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, সে অনুমান অমূলক নয়। দেশ ও জাতির এই সংকটকালে রাষ্ট্রের ভ‚মিকা কোনো ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। রাষ্ট্র দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য বা বিবেচনায় না নিয়ে বিপরীত কর্মেই অধিক উৎসাহী হয়ে উঠেছে। জুন মাসকে উপলক্ষ করে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের ওপর বিল আদায়ে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, ওয়াসা জুন মাসে বকেয়া আদায়ের অভিযানে নেমেছে। মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিষয়টি ন্যূনতম আমলে না নিয়ে নোটিস পাঠিয়ে, বাড়ি বাড়ি উপস্থিত হয়ে জুনকেন্দ্রিক বকেয়া পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের ফাঁদে ফেলে ঘুষও আদায় করছে। ওদিকে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি পরিশোধের জন্য কাবুলিওয়ালাদের মতো কঠোর চাপ প্রয়োগ করে চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি আদায়ে উৎপীড়ন জারি রেখেছে। বাড়ি ভাড়া নির্ভর মানুষেরা ভাড়াটে সংকটে দিশাহারা। জীবিকা হারিয়ে ভাড়াটেরা পরিবারকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজেরা বিকল্প জীবিকার খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরছে। ভাড়াটে সংকটের মুখে তাদের ওপর সিটি করপোরেশনের জুন মাসকেন্দ্রিক কর আদায়ের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোর বাড়ির মালিকরা, অতীতের জুন আর এই জুনের ক্রান্তিকালের তোয়াক্কা করছে না করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের মিটার রিডারেরা মিটার না দেখে তাদের মর্জিমাফিক বিল প্রদান করে, ভুতুড়ে বিলের বোঝা চাপিয়েছে গ্রাহকদের ওপর। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারের পর গ্রাহকদের ভুতুড়ে বিলের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। অথচ সংযোগ সচল রাখতে বেশিরভাগ গ্রাহকই ইতোমধ্যে ভুতুড়ে বিল প্রদান করেছে। গ্রাহকদের থেকে আদায়কৃত অতিরিক্ত মিটারবহিভর্‚ত বিল পরবর্তী সময় সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে, তবে সেটা বাস্তবায়িত হলে ভালো আর না হলে গ্রাহকদের তো কিছুই করার নেই। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরাও অতীতের তুলনায় প্রিপেইড কার্ডের অর্থ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করছে। রাষ্ট্র যেখানে এই দুঃসময়ে জনগণের পাশে দাঁড়াবে, সেখানে রাষ্ট্র এখন চরম নিপীড়কের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, গ্যাস সরবরাহকারী রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জুন মাসকেন্দ্রিক অনাচারে গ্রাহকদের নাভিশ্বাস অবস্থা অথচ রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার নির্বিকার, নির্লিপ্ত। করোনা পরিস্থিতি সামনে আরো নানা মাত্রার আপদ-বিপদ নিয়ে যে আসছে সেটা তো সত্য। সেই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে রাষ্ট্র এবং সরকার? পরিস্থিতির আগাম অনুমানে আঁতকে উঠতে হয়। অথচ সরকারের কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে জানা যায় না। দেশের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রেও হতাশাজনক অবস্থা। মানুষকে হয় করোনায় মরতে হবে নচেৎ অনাহারে। দেশে খাদ্যপণ্যের হয়তো অভাব হবে না। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা সমষ্টিগতদের যে থাকবে না বর্তমান অবস্থাই সেটা প্রমাণ করে দেয়। জীবিকাবিহীন অনাহারি মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বৃদ্ধির ঘটনাও অসম্ভব নয়। সর্বক্ষেত্রেই আমাদের জীবন অনিশ্চয়তার পথেই এগোচ্ছে। শুভ সম্ভাবনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের অনেক দেশ করোনায় মারাত্মক আক্রান্তের এবং অধিক মানুষের মৃত্যুর পরও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেসব দৃষ্টান্ত আমাদের সরকার অনুসরণ করলে নিশ্চয় সুফল পাওয়া যেত। অনেক বিলম্বে আমাদের দেশে করোনার আগ্রাসন এলেও করোনার উৎপত্তি দেশ চীনকে আমরা ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছি। দেশে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কে বাঁচবে, কে মরবে সেটাও অনিশ্চিত। একদিকে করোনার ছোবল অপরদিকে খাদ্য নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা আমাদের দিশাহারা করে তুলেছে এবং সামনে আরো ব্যাপকভাবে দুটিই আক্রান্ত করবে। আমাদের সামষ্টিক মানুষের জীবন, জীবিকা এবং ভবিষ্যৎ পুরোটাই অনিশ্চিত। করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিয়ে জনমনে আস্থাহীনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ রোগীদের একমাত্র ভরসা, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের বেহাল দশার পরও সেখানে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। বেসরকারি চিকিৎসা-বিক্রয় কেন্দ্রগুলো সুযোগের মওকায় মৃত অথবা সুস্থ রোগীদের পকেট কাটছে বেশুমারভাবে। লাখ লাখ টাকা রোগী পিছু আদায় করছে। অনেক অভিযোগের পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি অনেক চিকিৎসা কেন্দ্রে করোনা পরীক্ষার কিটস সংকটে মানুষের ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে। হয়েছে বিক্ষোভও। আক্রান্ত প্রচুর রোগী হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছে। বাস্তবে রোগটির প্রতিষেধক আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। সামাজিক দূরত্ব, জনসচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমাদের নাগরিকদের সচেতনতার অভাব নিশ্চয় রয়েছে। কিন্তু তাদের বাধ্য না করার ফলেই তারা ইচ্ছামতো রোগ বিস্তারে ভ‚মিকা পালন করছে। তাদের বাধ্য করা হলে কিংবা নজরদারি করলে নিশ্চয় তারা নির্দেশনা পালনে বাধ্য হতো। তেমন লক্ষণ কিন্তু দেখা যায়নি। চিকিৎসক, নার্সদের নিম্নমানের মাস্ক এবং পিপিই সরবরাহে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে এযাবৎ অনেক ডাক্তার, নার্সকে জীবন দিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের প্রতিটি সেক্টর এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তারা কেউ আর জবাবদিহিতার নাগালে নেই। অনেকে নাকি দেশ থেকে তাদের দ্বিতীয় আবাস অন্য দেশে চলে যাওয়ার ফন্দি-ফিকির করছে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম, তেমন উপলব্ধি তাদের। তাদের নানা পন্থায় অর্থ বানিয়ে বিদেশে পাচার করে দ্বিতীয় আবাস তৈরির সংবাদ নতুন নয়। বহু আগে থেকে অমন সংবাদ দেশে প্রচার পেয়ে এসেছে। কথায় আছে, চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণির চুরি-লুণ্ঠন ধরা পড়লেও তারা স্বাধীনতার বিগত অর্ধ-শতাব্দীতে ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। কাউকে কৃত অপকর্মের দায় বহন করতে হয়নি। আমাদের সামষ্টিক জীবন এখন চরম ঝুঁকির কবলে, তেমনি জীবিকাও। তবু আমরা আশাবাদী হতে চাই। নিশ্চয় করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে। আমরা স্বাভাবিক জীবন, জীবিকা ফিরে পাব। বিদ্যমান অব্যবস্থা, অনাচার মুক্ত হয়ে নতুন দিনের শুভসূচনায় নতুনভাবে বাঁচব- সেটাই প্রত্যাশিত।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App