×

মুক্তচিন্তা

পাটশিল্পে সংকটের ব্যবচ্ছেদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২০, ০৬:১৪ পিএম

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্প আজ ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ৯ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাটকল শ্রমিকরা বেতনভাতার দাবিতে আমরণ অনশন পালন করেছিলেন। তখন ৪ মাস ধরে তাদের মজুরি পরিশোধ করেনি সরকারি পাটকল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিজেএমসি। এখন গত ২৯ জুন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ ঘোষণায় পাটশিল্প নিয়ে নতুন করে তৈরি হয়েছে চরম উত্তেজনা। সরকার প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী পাটকল শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার বলছে, পাটকলগুলোকে সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় নতুন করে চালু করা হবে। কিন্তু চাকরি হারানো শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেছেন সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে। কারণ তাদের কাছে কর্মসংস্থান হারানোটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সামনে তারা আমরণ অনশনে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। পাটকল শ্রমিকদের অনশনের মাধ্যমে এর আগেও অনেক শ্রমিককেই প্রাণ দিতে দেখেছি। কিন্তু তাদের বঞ্চনা কমতে দেখিনি। সরকারি পাটকলগুলোতে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী ও ২৬-২৭ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক কর্মরত আছেন। এই অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষের ওপর নির্ভর করে বাঁচছেন তাদের পরিবারের কয়েক লাখ মানুষ। আশির দশকের পর থেকে সরকারগুলোর ভুলনীতি ও সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাবে সোনালি আঁশ পাটশিল্পের দুর্দিন চলছে! ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর ঘোষণা দেন। বন্ধ করে ফেলা আদমজী জুটমিল আবার চালু করেন। সরকারের নতুন কৌশলের সুফলও মেলে খুব দ্রুত। আশির দশকের পর প্রথমবারের মতো পাটশিল্প লাভের মুখ দেখে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লাভ হয় পাটশিল্প থেকে। লভ্যাংশ খুব বড় অঙ্কের না হলেও দীর্ঘদিনের লোকসানের বৃত্ত যে ভেঙে গেল- সেটাই ছিল আশাজাগানিয়া! ২০১০-১১ অর্থবছরের পর থেকে আবার পশ্চাৎযাত্রা শুরু করেছে পাটশিল্প! ক্রমেই ভয়াবহ সংকটে পড়ে গেছে এই ক্ষেত্রটি। শ্রমিকের বেতন দিতেও সরকারের কাছে হাত পাতছে বিজেএমসি। প্রতি বছর সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে পাটশিল্পে! ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৪৮১ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৬৬ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ৬০০ কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এরপরও রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাটশিল্পের রপ্তানি আয় ছিল ১০২ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই রপ্তানি আয় কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এই সেক্টরের রপ্তানি আয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট রপ্তানির মাত্র ২.০১ শতাংশ। অথচ এই খাতটিই একসময় ছিল রপ্তানি আয়ের মূল উৎস! পাটশিল্পে সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ হলো পাটকলগুলোর পুরনো যন্ত্রপাতি। এখন সরকারি ২৫টি কারখানায় মোট ১০ হাজার ৮৩৫টি তাঁত রয়েছে। এগুলো ৫০-৬০ বছরের পুরনো হওয়ায় কর্মদক্ষতা মোটের উপর নেমে এসেছে ৪৫ শতাংশে। তাই নতুন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করলে উৎপাদন যেমন বাড়বে না, তেমনি লোকসানও কাটবে না পাটশিল্পের। পাটশিল্পের ক্রমাবনতির দ্বিতীয় কারণটি হলো পাটের মৌসুমে পাট সংগ্রহ না করা। পাটের মৌসুম জুন-জুলাইয়ে পাটের মূল্য থাকে মণপ্রতি ১ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। তখন পাটকলগুলো পাট কিনলে একদিকে যেমন অল্পদামেই পাট সংগ্রহ সম্ভব, অন্যদিকে পাটচাষিরাও তাদের ন্যায্য দাম পেতে পারে। কিন্তু সরকার অর্থছাড়ে বিলম্ব করায় ওই সময়ে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে অল্প দামেই পাট কিনে নেয়। পাটশিল্পে সংকটের তৃতীয় কারণটি হলো বিজেএমসি কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়ম। তাদের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র মাঝে মাঝেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এই দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবেআধুনিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন এবং সর্বোপরি পাট মন্ত্রণালয়, পাট অধিদপ্তর ও বিজেএমসির সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানো সম্ভব। দেশের সাধারণ মানুষও সেই আশায় সরকারের পরিকল্পনার দিকে তাকিয়ে আছে।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App