×

মুক্তচিন্তা

করোনা হাসপাতালের ৬৭ শতাংশ শয্যা খালি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২০, ০৬:৩২ পিএম

প্রকৃতি বড় নিঠুর তার নিয়মে। অসত্যকে মেনে নেয় না, নেয়নি কখনো। অতীতে তার অজস্র প্রমাণ আছে। মনগড়া কথা বলে বাস্তব অবস্থাকে না এড়িয়ে ‘সত্য’ হতে পারে মুক্তির পথ। আসুন আমরা সবাই মুক্তি পাই, বেঁচে যাই। যেটা এবং যতটুকু সত্য, সেটা বলি। তার ওপর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিই এবং তা স্বচ্ছতার সঙ্গে।

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্য দিন দিন বাড়ছে। লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্স, ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদি সব ধরনের অবস্থা ও ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই সংক্রমণ বৃদ্ধি। সংক্রমণ রোধে সমন্বয়হীন পরিকল্পনা গ্রহণও থেমে নেই। একটা কথা না বললেই নয় যে, করোনা বাংলাদেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার আসল চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। একটা ভারসাম্যহীন ও জীর্ণ আবাসনের ভেতর যেন ছিল আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সাধারণ মানুষ কেন শুধু, বিত্তবান শ্রেণিও আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা পেতে পারেননি, পারছেন না অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও করোনার উপযুক্ত চিকিৎসা অনুসন্ধানে, উদ্ভাবনে গোটা বিশ্ব তৎপর। কিন্তু তারপরও প্রাথমিকভাবে যেভাবে, যে চিকিৎসাব্যবস্থায় করোনায় আক্রান্তদের বাঁচিয়ে তুলতে অবিরত চেষ্টা বিশ্বব্যাপী, দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই চেষ্টার অসম্পূর্ণতা, সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। তারই উপযুক্ত দৃষ্টান্ত হলো, করোনায় চিকিৎসায় হাসপাতালে ৬৭ শতাংশ শয্যাই খালি। স্বয়ং আইইডিসিআরের সূত্র মতে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে যাচ্ছেন না। সারাদেশে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত শয্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থাৎ ৬৭.৪৮ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে। একই সূত্র মতে, ৯৩.৫৬ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে। এই তথ্যে কী ভেবে নেয়া যায় যে, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রভাব মৃদু এবং বাসাতেই চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা যায়, সুস্থ হয়ে উঠছে মানুষ। মোটেও তা নয়। কারণ বাসাতেও করোনায় আক্রান্তের মৃত্যু ঘটছে। রোগীর অবস্থা গুরুতর খারাপ হচ্ছে। করোনায় আক্রান্তদের অবস্থা গুরুতর না হলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না। গুরুতর হলেই রোগীকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাকে অক্সিজেন দেয়াসহ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। আইইডিসিআরের এক হিসেবে দেখা গেছে যে, গত ছয় দিনে মোট মৃত্যুর ২৩ শতাংই হয়েছে বাসায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ার পরও অনেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। কারণ কী? অবশ্যই এর কারণ আছে এবং যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২৬ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনে বলা হয়, দেশের সব বিভাগ মিলিয়ে করোনার রোগীদের জন্য মোট সাধারণ শয্যা আছে ১৪ হাজার ৬১০টি। আইসিইউ আছে ৩৭৯টি। ৪ হাজার ৬৯১ জন ভর্তি আছেন সাধারণ শয্যায় এবং ১৮৩ জন আইসিইউতে। সাধারণ শয্যা কিংবা আইসিইউ খালি থাকার পরও করোনায় আক্রান্তরা সহজে ভর্তি হতে পারছেন না। পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ার এমন সংবাদ অহরহ দেখা যায় যে, করোনায় আক্রান্ত রোগী তো নয়ই, এমনকি সাধারণ রোগে মানুষ এখন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। চারপাশ থেকেও এমন আক্ষেপ অনেকেরই। যদি করোনার রোগীরা ভর্তি হতে না পারেন তাহলে তো আইসিইউ কিংবা সাধারণ শয্যা তো খালি থাকবেই, তাই না? আবার অনেকে মনে করছেন যে, কোভিড-১৯ এর রোগীর জন্য আইসিইউ বা হাসপাতালের সাধারণ শয্যা খালি আছে, সংশ্লিষ্টদের এমন সংবাদ প্রচারের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য হয়তো থাকতে পারে। হতে পারে, প্রথমত, তারা বুঝাতে চাইছেন সংক্রমণের তুলনায় তাদের প্রস্তুতির মাত্রা বেশি, তাই এসব খালি। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসাপত্রে ঘরে বসেই করোনায় আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাই হাসপাতালমুখী হতে রোগীদের নিরুৎসাহিত করা যেন হাসপাতালে খালি থাকে। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পিত লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্স ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশে করোনাকে জয় করা সম্ভব হচ্ছে, তাই আইসিইউ বা শয্যা খালির এই অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি এমন উদ্দেশ্য নিয়েই আইসিইউ বা শয্যা খালির সংবাদ প্রচার করা হয় তাহলে তা হবে সত্যিই দুঃখজনক। রীতিমতো প্রহসন। বাস্তব অবস্থাটা কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। সম্প্রতি আমার এক পরিচিত ব্যক্তি তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে পড়েছিলেন বিপাকে। বুকের ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতালে গিয়েও আইসিইউতে তার ঠাঁই মেলেনি। তাকে শেষমেশ সুপরিচিত নয় এমন এক হাসপাতালে আইসিইউতে ঠাঁই নিতে হয়। যেখানে আইসিইউ চার্জ ২৪ ঘণ্টার জন্য ৪০ হাজার টাকা। তার ওপর তো অন্যান্য খরচ আছেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যাদের অর্থ নেই, চেহারামূল্য নেই, নেই প্রভাব-প্রতাপ পরিচিতি তাদের কথা ভাবুন পাঠক। অসহায়ত্ব ছাড়া কোনোকিছু আর সেখানে দৃশ্যমান হয় না। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পেছনে যে ভয় এখানে, তা ভর্তি হতে না পারার সঙ্গে আরো আছে আর্থিক অসঙ্গতি, চেহারামূল্য না থাকা। শয্যা আর আইসিইউ তো সে কারণেও খালি থাকতে পারে। এদিকে করোনার ফি ধার্য করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে করোনার উপসর্গ নেই, এমন মানুষও টেস্ট করাচ্ছেন। এই প্রবণতা রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ কী কিটের অভাব, নাকি যত কম টেস্ট তত কম আক্রান্তের সংখ্যা? কিন্তু এতে যে কর্মহীন দরিদ্র মানুষেরা মহাসংকটে পড়বেন, মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বেন, তারা করোনার উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই চিন্তা নেই কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাথায়! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সূর্য ওঠার আগেই যে করোনা পরীক্ষার জন্য মানুষের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয় সেটা সংশ্লিষ্টদের কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত তারা জানেন না এই লাইনে সবাই দাঁড়িয়ে থাকেন না। কেউ বসে, কেউ শুয়ে অপেক্ষায় থাকেন। তাদের কেউ কেউ আবার মৃত্যুও কোলেও ঢলে পড়েছেন। এমন সংবাদ তো মিডিয়ায়ও এসেছে। ফি ধার্য করার জন্য এই লাইনও ছোট হয়ে আসবে হয়তো। তখন হয়তো সংশ্লিষ্টদের পক্ষে বলা সহজ হবে, দেশে করোনা ঝিমিয়ে গেছে। তাই সংক্রমণ নেই, নেই আক্রান্ত। করোনাকে জয় করা সম্ভব হয়েছে। জয়ী হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাহ্ স্বাস্থ্যমন্ত্রী! শাবাশ! একদিকে মানুষ কর্মহীন অবস্থায় বিপন্ন জীবনযাপন করছে, চাকরিচ্যুত হচ্ছে। ইতোপূর্বেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণও শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করে সরকার প্রধান প্রণোদনার কথাও ঘোষণা করেছেন। তেমন অবস্থায় করোনার টেস্টের ফি ধার্য করা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, যৌক্তিক ও মানবিক, ভেবে দেখা দরকার ছিল। বোধহয় ‘স্ববিরোধিতা’ বিষয়টি অনেকেই বুঝেন না। কিন্তু দিন দিন সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে। এই সত্যকে কী করে আড়াল করবেন কর্তৃপক্ষ? প্রকৃতি বড় নিঠুর তার নিয়মে। অসত্যকে মেনে নেয় না, নেয়নি কখনো। অতীতে তার অজস্র প্রমাণ আছে। মনগড়া কথা বলে বাস্তব অবস্থাকে না এড়িয়ে ‘সত্য’ হতে পারে মুক্তির পথ। আসুন আমরা সবাই মুক্তি পাই, বেঁচে যাই। যেটা এবং যতটুকু সত্য, সেটা বলি। তার ওপর উপযুক্ত ব্যবস্থা নিই এবং তা স্বচ্ছতার সঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা হোক সবার জন্যই এবং তা রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছায় উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App