×

অর্থনীতি

কঠোর আন্দোলনে শ্রমিকরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০, ০৯:২৯ এএম

২৫ হাজার পাটকলকর্মীকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সরকারের

পাটশিল্পের লোকসান ঠেকাতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে মজুরি কমিশন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করে বিদায় (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পাটকলের জমি দখলের পাঁয়তারা বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। তারা বলেন, এই শিল্পের উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। বরং বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি যাতে পাটকলের জমি দখল করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘শ্রমিক ছাঁটাই’ তারই অংশ। তবে পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দুই দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচির ঘোষণা করেছে শ্রমিকরা। অবশ্য শ্রমিকদের আন্দোলনের হুমকির মুখে বিষয়টি সরকারের পক্ষে থেকে বিবেচনা করছে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়।

শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যৌথভাবে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে পাটকল শ্রমিক লীগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ ও নন-সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রক্ষা সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে গতকাল আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে আজ ২৯ জুন সকাল ৯টায় স্ব স্ব মিল গেটে শ্রমিক-কর্মচারীদের সন্তানদের নিয়ে অবস্থান ও ৩০ জুন ২টায় স্ব স্ব মিল গেটে শ্রমিক-কর্মচারীদের অবস্থান, ১ জুলাই দুপুর ২টা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সব মিলের স্ব স্ব গেটে শ্রমিক-কর্মচারীদের সন্তানদের নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পাটশিল্পের ক্রমাগত লোকসান ঠেকাতে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলোর ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছায় অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

পাটকলগুলো বন্ধ রেখে পাওনা পরিশোধের পদ্ধতিসহ শ্রমিকদের অবসরের বিষয়টি কিছুদিনের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের (অবসর) বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন মজুরি কমিশন অনুযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি চ‚ড়ান্ত করে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় পাটকল রয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে একটি (মনোয়ার জুট মিল) বন্ধ রয়েছে। পাটকলগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৬৬ জন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ করলেও নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বছরের পর বছর লোকসান গুনছে সরকারি পাটকলগুলো।

বিজেএমসির কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো কিছুই ঠিকমতো হচ্ছিল না। তাই সরকার আর পাটকলের লোকসানের বোঝা বইতে চাইছে না। সে জন্য স্থায়ী শ্রমিকদের স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেটি শেষ হলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পাটকলগুলো চালানো হবে। পাটকলের ব্যবস্থাপনাও বেসরকারিকরণ করা হবে। কর্মসূচি অনুযায়ী সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিকদের অর্থ দেয়া শুরু হতে পারে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বছরের পর বছর পাটকলগুলোতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাই এই শিল্পের পুনর্গঠন হওয়া দরকার। তবে পিপিপি করার আগে অতীতের আদমজীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। কাদের কাজ দেয়া হবে, তারা কীভাবে পরিচালনা করবেন তা স্পষ্ট করতে হবে। বর্তমানে যে মেশিন রয়েছে তা কীভাবে আধুনিকায়ন করা হবে তার প্ল্যানও থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পাটের সোনালি ঐতিহ্য রয়েছে। তাই পাট ও পাটজাত দ্রব্য ব্র্যান্ডিং করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে পাটজাত পণ্য ব্যবহারেও গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সরকারের অনেক আগের। তারই অংশ হিসেবে আদমজী বন্ধ করা হয়। পাটকল বন্ধের অন্যতম কারণ হলো এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিল তা যথাযথ কাজে লাগাতে পারেনি। তিনি বলেন, এই শিল্পের উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। বরং বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি পাটকলের জমি দখল করতে পারে তার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। আর শ্রমিক ছাঁটাই তারই একটা অংশ।

সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। পিপিপির মাধ্যমে পাটকল চালানোর পক্ষে আমরা নই। আমরা চাই, ‘নো ওয়ার্ক-নো পে’ নীতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণেই পাটকল চলবে। আমরা পাটকল শ্রমিক লীগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ ও নন-সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ যুগপৎ আন্দোলন করব।

খুলনার শিল্পাঞ্চলে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রক্ষা সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হামিদ সরদার বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধ মিল-কলকারখানা চালু করে মৃত নগরী খুলনাকে জীবিত করেছেন। শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে পাটকল বন্ধের জন্য চক্রান্ত চলছে। মিলের উৎপাদন অব্যাহত রেখে পাটশিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারের প্রতি জোর আহ্বানও জানান তিনি। এই শ্রমিক নেতা বলেন, পাটকল রক্ষায় প্রয়োজনে আত্মাহুতির মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা জানতে পেরেছি- রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অবশিষ্ট ২৫টি পাটকল আদমজী জুট মিলের কায়দায় বন্ধ করে শ্রমিকদের কর্মের অবসান ঘটানো হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অন্যায় ও অযৌক্তিক।

শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বাধাগ্রস্ত হবে কি না জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ বলেন, আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব বিজেএমসির কাজ নয়। বিষয়টি দেখবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে জন্যই গত বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক হয়েছে। তিনি বলেন, পাটকল শ্রমিকরা ভুল বুঝছেন। সরকারি পাটকল কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সেগুলো পরিচালনায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো কোনো দিক দিয়েই ঠিকমতো চলছে না। বেসরকারি পাটকলের চেয়ে খরচ তিন গুণ বেশি। ফলে সরকার টাকা দিলেও পাটকলগুলো চালানো সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলেই গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের কাজ শুরু হবে বলে এই কর্মকর্তা জানান।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম এনডিসি বলেন, শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। বিবেচনা করছে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের দাবি। এ লক্ষ্যে আজ শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন আন্দোলনকারীরা।

সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেয়া প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বলেন, দেশের পাট খাতে ব্যক্তির অংশ এখন ৯৫ শতাংশ। সরকারি মিলগুলোর অংশ মাত্র ৫ শতাংশ। সরকারি পাটকলগুলোতে প্রতিনিয়ত লোকসানের টাকা দেয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। শ্রমিকদেরও সবসময় আন্দোলন করে টাকা আদায় করতে হয়। ৯ হাজার কর্মী এখনো পেনশনের টাকা পায়নি। তাছাড়া আগে সরকারি মিলগুলোকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বিক্রি না করে জুট মিল রাখা হবে। তবে এমন ম্যানেজমেন্ট দেয়া হবে যাতে লোক ছাঁটাই না হয়। শ্রমিকরা সেখানেই চাকরি পাবে, কারণ দক্ষ কর্মী ছাড়া মিল চালাতে দেয়া হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App