×

পুরনো খবর

লাদাখের পর ঢাকা : সাংবাদিকতার ভাষা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২০, ০১:০১ পিএম

লাদাখের পর ঢাকা : সাংবাদিকতার ভাষা

বাংলাদেশ আসলে ভারত কিংবা চীন কোনো বলয়ভুক্ত হওয়ার নয়, উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখবে, উভয়কেই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে প্রত্যাশা করবে। যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, সীমান্তের ওপর থেকে যে কেউ ভারতমাতার দিকে তাকালে দুচোখে গনগনে গজাল ঢুকিয়ে দেবেন আর লাদাখে চীনে বাহিনী কচুটাও করতে পারেনি সেখানে সংবাদপত্রের অশোভন পরিবেশনা বিশে^র দ্বিতীয় বৃহৎ গণতন্ত্রের চেহারাটা দেখিয়ে দেয়।

‘লাদাখের পর ঢাকাকে পাশে টানছে বেইজিং’- শুধু এই শিরোনামটুকু পড়ে যিনি অন্য খবরে চলে যাবেন তাকে এটাই বুঝতে হবে যে বেইজিং প্রথম লাদাখকে কাছে টেনেছিল তারপর ঢাকাকে। লাদাখের সঙ্গে ঢাকার কী সম্পর্ক কিংবা কেন লাদাখের সমান্তরালে ঢাকাকে টানা হলো তা আনন্দবাজার পত্রিকার বিজ্ঞ সম্পাদক এবং তার পরিষদ ভালো বলতে পারবেন। ঢাকা স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাজধানী। লাদাখ কোন দেশের রাজধানী? এর জবাবও আনন্দবাজারই দেবে। আনন্দবাজার বাংলাদেশের সংবাদপত্র পাঠকদের প্রিয় পত্রিকাগুলোর অন্যতম। এই গ্রুপের মালিকানাধীন, দীর্ঘদিন সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত সাপ্তাহিক দেশ ছিল আমার নিত্যকার প্রিয় পাঠ। আমার সংগ্রহে যে পরিমাণ পুরনো দেশ ছিল এবং এখনো আছে খুব কমসংখ্যক পশ্চিমবঙ্গীয় ভারতীয় নাগরিকের সংগ্রহে তা থাকার কথা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতাই আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আমি একাত্তরের ইন্দিরা ও প্রিয়দর্শিনী গান্ধী- বাংলাদেশি ৫০০ টাকা দামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছি। সেখান থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করতে চাচ্ছি : ‘১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধী যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন, প্রধানমন্ত্রী থাকতেন সম্ভবত মোরারজি দেশাই কিংবা চরণ সিং কিংবা জগজীবন রাম। গুলজারিলাল নন্দা এবং রামস্বামী কামরাজও প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাশীদের মধ্যে ছিলেন। পরের পাঁচজনের যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো বিশাল ঘটনাটি অনেকটাই পিছিয়ে যেত। তাদের মধ্যে যিনিই প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসুন না কেন, অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্ব ও আঞ্চলিক ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াইয়ে তাকে একটি দুর্বল সরকারের নেতৃত্ব দিতে হতো। তাদের কেউই রক্ষণশীল চরিত্র নিয়ে দেশীয় সংকট পাশ কাটিয়ে অথবা মোকাবিলা করে নিক্সনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সংকট নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো অবস্থায় থাকতেন না। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতের জনগণ তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া ইতিহাসের সর্ববৃহৎ শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করেছে, প্রত্যক্ষভাবে রণাঙ্গনে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে।’ ভারতের বিজয়ের কারণে একাত্তরের যুদ্ধটার নাম হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বাংলাদেশের শরিকানা তাতে প্রায় অনুপস্থিত, যারা ঢাকাকে স্বাধীন দেশের রাজধানী হতে অবদান রেখেছেন তাদের সাংবাদিক যদি লাদাখ আর ঢাকা একাকার করে ফেলেন, তারাই তো তাদের অবদানকে তুচ্ছ করে ফেলছেন। চীনা প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে পুষ্পাসনে দোল খেয়েছেন, তা ফুলডোরে বাঁধা ছিল কিনা জানি না, তবে ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে প্রচার করেছে একে প্রথম বাসর শয্যার চেয়ে কম কিছু মনে হয়নি। সেক্ষেত্রে কাগজে সংবাদের শিরোনামটা এমন হতে পারত : ‘দিল্লির পরে ঢাকাকে কাছে টানছে’। অবশ্যই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে, ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারে, নব্য ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড সৃষ্টির তাগিদে চীনের জন্য ঢাকার চেয়ে দিল্লি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই দিল্লিকেই প্রথম ভালোবাসার কনফুসিয় দাওয়াই এবং চৈনিক আকুপ্রেশার দেয়ার কথা। কিংবা যদি ভারত সরকারের দোল খাওয়ার ঘোর কেটে গিয়ে থাকে তাহলে লাদাখের জায়গায় অন্য কোনো অমিত্র দেশের রাজধানীর নাম বসিয়ে দিলেও আনন্দবাজারের তুলনাজ্ঞানের ঘাটতি আছে এমনটা মনে হতো না। ভুলভ্রান্তি বাংলাদেশের পত্রিকাও করে থাকে, অনেক পত্রিকার এখনো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও হয়নি, কিন্তু আনন্দবাজারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান করলে তা বড় হয়ে চোখে একটু বেশিই পড়ে। বেশ তো, যা হওয়ার হয়েছে, ক’দিন পরই তো ভুলে যাবে চুপচাপ থাকলেই হতো, কিন্তু তা না করে করে আবার ‘ভুলভাবে’ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে ব্যাপারটা জিইয়ে রাখল। ক্ষমা চাইলে, আরে তাতে কী এসে যায় বলে মুচকি হেসে ক্ষমা তো অবশ্যই করে দিতে হবে। তার আগে দেখা যাক ক্ষমাটা কিসের জন্য? আমি ভেবেছিলাম সম্ভবত লাদাখ আর ঢাকাকে এক কাতারে ফেলার ভ্রান্তি ঘুচাবার জন্য। কিন্তু তা নয় : ‘ভ্রম সংশোধন : লাদাখের পরে ঢাকাকে পাশে টানছে বেইজিং’ শীর্ষক খবরে (২০.৬, পৃ. ৮) খয়রাতি শব্দের ব্যবহারে অনেক পাঠক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী। আহত হয়েছেন বলে কোন কোন পাঠক আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন তারাই ভালো জানেন। ভারতের পাঠক না বাংলাদেশের পাঠক? যদি কেউ না জানাতেন তাহলে কি শব্দটি কি নিষ্কলুষ ও বন্ধুসুলভ হয়ে যেত? শব্দের মানে খুঁজতে আমি ভারতবর্ষে প্রকাশিত বাংলা অভিধানই আগে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এমনকি আনন্দবাজার পত্রিকারও নিজস্ব একটি অভিধানতুল্য শব্দগ্রন্থ আছে। সেখানে সাংবাদিকতার নসিহতও আছে। অনেক আগে প্রকাশিত বলে এটা তারা খারিজ করে দিয়েছেন কিনা জানা নেই। ভারতীয় অভিধানের মানেই হচ্ছে দয়ার দান, প্রকারান্তরে ভিক্ষাবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত। হতে পারে শব্দটি পবিত্রও। খয়রাতির অর্থ অবমাননার হলেও খয়রাতি জ্ঞান তো তুচ্ছ হতে পারে না। বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকার নিয়মিত লেখক জর্জ মনবিয় বক্তৃতা দিতে এলে কিছু ফি চার্জ করে থাকেন, কমবেশি আমিও চেয়ে থাকি। কিন্তু স্ট্র্যাটফোর্ডের কাছাকাছি রমফোর্ড রোডের একটি ক্যাম্পাসে তিনি বক্তৃতা করতে এসে প্রথমেই বললেন তিনি আয়োজনকারীদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি চার্জ করেননি। তিনি যা বলবেন, একেবারে ফ্রি অব কস্ট, খয়রাতিও বলা যায়। তার তখনকার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘No Man’s Land : An Investigative Journey through Kenya and Tanzania’ কেবলই সাগ্রহে পাঠ করা শেষ করেছি। এই বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আফ্রিকার অরণ্যাঞ্চল ও আমাজন অরণ্যাঞ্চলের আদিবাসী সংস্কৃতির একটি উদাহরণ দিলেন। মৃত বানরের দাঁত দুই অঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ। এক অঞ্চলে মৃত বানরের দাঁত দিয়ে মালা বানিয়ে কমিউনিটির শ্রেষ্ঠ মানুষটির গলায় পরিয়ে সম্মান জানানো হয়। অন্য অঞ্চলে একই রকম সুতোয় গাঁথা একই রকম মালা পরিয়ে অনৈতিক কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত (অনৈতিক কাজের একটি উদাহরণ হচ্ছে অধিকতর বয়স্ক ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম) অপরাধীর গলায় পরিয়ে ধিক্কার দেয়া হয়। কিন্তু কোন অঞ্চলে সম্মানের আর কোন অঞ্চলে ধিক্কারের তা আমি সত্যিই ভুলে গেছি। অঞ্চল ভেদে খয়রাতির মানে মৃত বানরের দাঁতের মতো ভিন্ন হতে পারে এ নিয়ে লিখতে হবে যদি ১৯৯৫ সালে জানতাম তা হলে নোটবইতে টুকে রাখতাম। জর্জ মনবিয়র বক্তৃতার ওপর আলোচনার জন্য দুজন সাদা বক্তার সঙ্গে বাদামি বক্তা হিসেবে আমিও ছিলাম। মৃত বানরের দাঁত ভেবে আমি শব্দটিকে আনন্দবাজারের জন্য সম্মানজনকই ধরে নিয়েছিলাম, এ নিয়ে আমার ভেতর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, খয়রাতি লেখা নীচু মানসিকতার পরিচায়ক, তখন মনে হলো মন্দ বলেননি, পররাষ্ট্র মন্ত্রীসুলভই বলেছেন। যারা সুযোগ পেলেই নতজানু পররাষ্ট্র নীতি বলে খোঁচা দিতে চেষ্টা করেন, তারা এবার দেখুন। কিন্তু লাদাখের সঙ্গে ঢাকাকে মেলানোতে আমি যে ধাক্কা খেয়েছি সেখানে কিন্তু মৃত বানরের দাঁতের মতো দুই রকম মানে করার সুযোগ নেই। তবুও ভালো ভারতের ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি কাগজ এসব আবোল-তাবোল বলেছে, ভারত সরকার তো আর কিছু বলেনি। তারপরও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই একাত্তরে আনন্দবাজার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছে। ঢাকা থেকে ১৭১৬ কিলোমিটার দূরে লাদাখে যা ঘটেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দেখিয়েছে তাতে উপমহাদেশের জন্য একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, ভারতের বেলায় রক্তাক্ত এই ক্ষত শুকিয়েছে মনে করার কারণ নেই। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় ভারত টুয়েন্টি টুয়েন্টিতেই চীনের বিরুদ্ধে জিতেছে বলেই ধরে নিয়েছি, করোনাকালের লকডাউন না থাকলে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উপদ্রব না থাকলে প্রতিবেশী হিসেবে এই বিজয়ের বাতাসা ও জিলিপি কমবেশি হয়তো আমরাও পেতাম। লকডাউনের কারণে জিলিপি হয়তো সকলেই পাননি। ভেবেছি এই না পাওয়ার যাতনাতেই ওই সংবাদ শিরোনামে তারা ভুলবশত দিল্লির বদলে লাদাখ বসিয়ে দিয়েছেন।  আমরা সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী এবং তা সবার সঙ্গেই। ভারতের কাছে আমাদের অনেক শেখার আছে : থালা-বাসন বাজিয়ে ‘গো করোনা গো’ শিখে ঘাতক বিশ্বব্যাধি তাড়াব, না করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কেরালা মডেল অনুসরণ করব, সেটা নির্ভর করবে আমার ধারণক্ষমতা ও অভিরুচির ওপর।

***

ধনের ভিখারি হোক কি দীনের ভিখারি শেষ পর্যন্ত অর্জনটা মানুষের কাজে লাগলেই হলো। খয়রাতির অর্থে ধর্মশালা ও পাঠশালা উভয়ই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। বাংলাদেশের মানুষ টিআর আর জিআর দুটির সঙ্গেই পরিচিত। সরকারি দলের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাছবিচার করেন না। টিআর আর জিআরের নামে যা চাল-গম যাই আসে মেরে দিতে দ্বিধাও করেন না। টিআর হচ্ছে টেস্ট রিলিফ আর জিআর গ্র্যাচুইশাস রিলিফ, বাংলায় সরকারি আদেশে লেখা হতো খয়রাতি চাল বা খয়রাতি গম। টেস্ট রিলিফের চাল-গম বরাদ্দ হতো কাজের বিপরীতে আর খয়রাতিটা একবারেই মুফত, বিপন্ন মানুষের জন্য। একই এলএসডি (খাদ্য বিভাগের লোকাল সাপ্লাই ডিপো) থেকে উত্তোলন করা হতো। একই জিনিস একই পাল্লায় তুলে কোনোটাকে বলা হতো টিআর কোনোটাকে জিআর, খয়রাতি। যে নামেই ডাকুন না কেন মন্তেগু কিংবা ক্যাপুলেত জুলিয়েট তো বলেই দিয়েছে গোলাপ তো একই রকম মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াবে (যারা বিস্তারিত জানতে চান তাদের জন্য উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ লিখে রেখে গেছেন, একবার পাতা উল্টে দেখতে পারেন), আর টেস্ট রিলিফ কিংবা খয়রাতি যাই বলুন গমটা যে নিম্নমানের পোকালাগা কাঁকর মেশানো হবে তাতে সন্দেহ নেই। করুণার দান যদি কিছু মেলে তা ভারতের ভাগে পড়ুক কি বাংলাদেশের ভাগে পড়ুক, তা খয়রাতির গমের মতোই হবে। বিদেশি ঋণ, বিদেশি সাহায্য, বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি ছাড় এসব নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি কিংবা ডেস্কবন্দি প্রতিবেদক যিনি হোন সম্পাদককে ভালো একটা ধোঁকাই দিয়েছেন : ‘বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতির টাকা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয় চীনের।’ প্রতিবেদক ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এমন অসতর্ক পঙ্ক্তি রচনা করতেই পারেন। কিন্তু যে সম্পাদনা পর্ষদ যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে এটিকে ছাপিয়েছেন তাদের কাছে কি ভারতের বৈদেশিক ঋণ ও তাদের ভাষায় খয়রাতির পোর্টফোলিওটা ছিল না? না থাকার কথা নয়, আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ ও লাইব্রেরি এত দরিদ্র নয়। টাকার অঙ্কে তুলনা করলে ভারতের ঋণ ও খয়রাতির কাছে বাংলাদেশের অনুরূপ অর্থের আকার কিঞ্চিৎ মাত্র। পত্রিকা বাংলা প্রবচনটিকে সামনে নিয়ে এনে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে : চালুনি বলে সুচ, তোর গোড়ায় একটা ছিদ্র কেন? আমি আগেই বলেছি খয়রাতি শব্দটির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত হওয়ার কারণে এবং অঞ্চল ভেদে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে এবং পিএল ৪৮০-এর গমবাহী জাহাজ উপমহাদেশের কোন কোন বন্দরে ভিড়ত জানার কারণে আমার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। যদি বাস্তব খয়রাতিও হয়ে থাকে তবে কে বেশি খেয়েছে এবং কতগুণ বেশি খেয়েছে এ নিয়ে ভারতের অর্থনীতিবিদরা দেদার লিখেছেন। তাছাড়া ষাটের দশকে পাকিস্তানের গণমাধ্যমকে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে গিয়ে খয়রাতি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করতে আমরাও অনেকবারই শুনেছি। ভারতের পত্রিকা লিখছে : ‘লাদাখে চীনা আগ্রাসনের মোকাবিলা করছে ভারত সরকার (বিদেশি আগ্রাসনের মোকাবিলা করার দায়িত্ব কেবলই সরকারের না, রাষ্ট্রের। সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী মিহিন রেখাটা সাংবাদিক ঘষেমেজে উঠিয়ে দিয়েছেন)। পশ্চিম দিকে পাকিস্তান ইতোমধ্যেই চীনের কব্জায় (১৯৭১-এ চীন পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের খেদমত করেনি। যখন স্বাধীনতার পূর্বক্ষণে আকাশ থেকে ভারতীয় ছত্রীসেনারা প্যারাসুটে ভেসে ভেসে নেমে আসছিল পাকিস্তানপন্থি বাঙালিরা ফোঁস করে বলে উঠেছিল : এসে গেছে, মাও জে ডং-এর বিমানবাহিনীর প্যারাট্রুপার তাদের উদ্ধার করতে এবং পাল্টা লড়াই করে শত্রুদের হটিয়ে দিতে চলে এসেছে।) অতিসম্প্রতি আবার নেপালও ভারতীয় ভূখণ্ডের একাংশ নিজেদের দাবি করে মানচিত্র সংশোধন করছে (এ কেমন খয়রাতি!)। মালদ্বীপে কিছুটা হলেও জমি পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে। এহেন প্রেক্ষাপটে ভারতের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশেও আর্থিক সুবিধা দিয়ে কূটনৈতিক খেলায় নেমে পড়ল বেইজিং। শুক্রবার বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত হয়েছে চীনে।’ এদিককার পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন : চীনের দেয়া সুবিধা সম্পর্কে যে শব্দের ব্যবহার তারা করেছে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য- চীন যে সুবিধা দিয়েছে তা সে দেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ফসল। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ চীনের কাছে এই সুবিধা চেয়ে আসছিল। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি বেশি। এ সময়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দিয়েছে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে। জি নিউজও খবরটি বিকৃত করে বাজারে ছেড়েছে : ‘ভারতকে চাপে ফেলতে বাংলাদেশকে খয়রাতি চীনের।’ তারা শিরোনামে লাদাখ আনেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর লাদাখ ভাষণ বরং আমাদের বুঝতে বাধ্য করছে সেখানে বোচা নাকের চীনই বরং ভীষণ মার খেয়েছে। মেরে একেবারে তক্তা বানিয়ে দিয়েছে।

***

বাংলাদেশকে খাটো করে প্রকাশিত এ ধরনের সংবাদের বন্ধুত্ব-বিনাশী এবং বিব্রতকর কিছু প্রতিক্রিয়া রয়েছে : ক. আমার মতো আনন্দবাজার গ্রুপের প্রকাশনা-ভক্ত মানুষ জোর গলায় নামটি বলতে বাধার সম্মুখীন হবে। খ. যারা আনন্দবাজারের পুরস্কার ও উত্তরীয় ইত্যাদি পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে পাবেন বলে পথ-ঘাট পরিষ্কার করছেন তারা ভীষণ বিব্রত হবেন। তাদের অবস্থাটা হবে বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। গ. সুযোগ বুঝে রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তের এমনকি স্বাধীনতাবিরোধীদেরও কেউ কেউ বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মিছিল-মাহফিল করে আলোচনায় আসবেন। ঘ. ভারত অন্যতম প্রিয়বন্ধু বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে তাদের শত্রুর দিকেই ঠেলে দিতে থাকবে। ঙ. বাংলাদেশের দিকে একটি আঙুল তুলে নিজ দেশের দশটি দুর্বলতাকে দু’দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরবে। চ. চীনকে প্রকারান্তরে উসকানিও দেয়া হবে যেন ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মিত্র বৃদ্ধির প্রকল্প অব্যাহত রাখে। আনন্দবাজার কিংবা জি নিউজ কিংবা অন্য যে কোনো গণমাধ্যম এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আগ্রহী পাঠককে বরং ভারত-চীন সম্পর্কের একেবারে গোড়ায় নিয়ে যাবে, যার সূচনা সীমান্তের তিক্ততা দিয়ে। এ কালের মানুষ বালিতে মুখ গুঁজে থাকা উটপাখি নয়। এমনকি চীনের মতো রেজিমেন্টেড সোসাইটিতে কী ঘটছে তার ভিডিও ক্লিপ পেতে সময় লাগে না। সাংবাদিককে চ্যালেঞ্জ করার মতো অধিক্ষেত্র অনেক বেড়ে গেছে। কেবল ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায় নয়, সত্য উদঘাটনের কৃতিত্বেও তাকে হতে হয় অগ্রগামী।  কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশ ভারতের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য মিত্র। চীন যদি ভারতের শত্রু হয়ে থাকে তাহলে চীনের প্রাথমিক রণকৌশল এটাই হবে সেই বন্ধুদের নিজের দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করা। কিছু সুবিধা প্রদান কর্মকৌশলেরই অংশ হতে পারে- এর মোকাবিলায় এটা বলাই বিজ্ঞনোচিত হতো, ভারত চীনের চেয়েও বেশি সুযোগ দিয়ে তার মিত্রের আস্থা সৃষ্টি করুক। ভারতের বিজ্ঞজনের দাবি চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ থেকে বের করে দেয়া হোক। এক সময় আমেরিকাই উদ্যোগ নিয়েছে ভারতকে চীনের আসনে বসানো হোক। কিন্তু চীনের ভেটোর অধিকার তো ভারতকে ঢুকতেই দিচ্ছে না। ১৯৭১-এ ভারতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমেরিকার উদ্যোগের কোনো ঘাটতি ছিল না। এখন হাওয়া ঘুরেছে। আমেরিকান অ্যাক্সিসে প্রধান দক্ষিণ এশীয় মিত্র নরেন্দ্র মোদি। ভারত অবশ্য এটাও জানে পাকিস্তানের ক্রান্তিকালে তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি বড় কথা বলা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসেনি। ইয়াহিয়া খানের গৌরবের সৈন্যবাহিনী ধুলায় লুণ্ঠিত হওয়ার পরই সপ্তম নৌবাহিনীর জাহাজ এন্টারপ্রাইজ বহু দূর থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে উঁকি দিয়ে আবার মহাসাগরের দিকে চলে গেছে। বড়র পীড়িতি যে বালির বাঁধ, তাই তো প্রমাণিত হয়েছে। তখনকার বহুল প্রচারিত কথাটিও অনেকের স্মরণে থাকবে : আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন নেই। আমেরিকার ওপর ভরসা করে কোনো রাষ্ট্র লাভবান হয়নি, রক্ত ঝরিয়েছে। আর চীন? চীন কখনো নিজের খেয়ে মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এমন নজির আছে? একাত্তরে ভারত কেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এর ওপর বহু গবেষণাধর্মী রচনা খোদ ভারত থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। পূর্বাংশে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন না হলে সম্পূর্ণ অভিনিবেশ পশ্চিম রণাঙ্গনে করা সম্ভব হবে। একাত্তরের জেনারেলরা লিখিতভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন। ভারত-চীন যুদ্ধ কি আসন্ন?- ১৯৬২-এর থেকে প্রতি মৌসুমে এ প্রশ্ন শুনে মানুষ ক্লান্ত। তারপরও লাদাখ ও নেপাল সীমান্তে রাস্তা নির্মাণ করা নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা এ অঞ্চলে শান্তির হুমকি। পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধের জন্য ডিসেম্বর বেছে নেয়ার কারণ সে সময় হিমালয়ান পাস বরফরুদ্ধ থাকবে। চীন এগোতে পারবে না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পরপরই ১৯৬৯-এ ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ডায়েরিতে লিখলেন : পূর্বাঞ্চলে সেনা মোতায়েন থেকে ভারত বেঁচে গেল মনে করার কোনো কারণ নেই। হিমালয় সীমান্ত চীন কিছুসংখ্যক সেনা মোতায়েন করলেই ভারতকে পূর্ব সীমান্তে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে হবে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ কমে আসবে। তার ডায়েরি থেকে উদ্ধৃতি : ‘এটি পাকিস্তানের জন্য কালো দিন (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১), কেবল যে সাড়ে ছয় কোটি মুসলমানের একটি প্রদেশ ভারতীয় প্রভাব-বলয়ে চলে গেল তা নয়, আমাদের অত্যন্ত চমৎকার সেনা ডিভিশন, কিছু বিমান ও নৌশক্তি হাতছাড়া হয়ে গেল। তাদের কেমন করে মুক্ত করা হবে সেটাই বড় চিন্তা। এই জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনতে গেলে ভারত একটি বড় বিনিময় মূল্য চেয়ে বসবে।’ বাংলাদেশ আসলে ভারত কিংবা চীন কোনো বলয়ভুক্ত হওয়ার নয়, উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখবে, উভয়কেই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে প্রত্যাশা করবে। যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, সীমান্তের ওপর থেকে যে কেউ ভারতমাতার দিকে তাকালে দুচোখে গনগনে গজাল ঢুকিয়ে দেবেন আর লাদাখে চীনে বাহিনী কচুটাও করতে পারেনি সেখানে সংবাদপত্রের অশোভন পরিবেশনা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গণতন্ত্রের চেহারাটা দেখিয়ে দেয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ধ্রুপদ পরামর্শ দিয়ে যে চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন তার সবটাই প্রধানমন্ত্রীর জন্য নয়, গণমাধ্যমের জন্যও বিটুইন দ্য লাইন কিছু কথা আছে তা বোঝার ক্ষমতা সম্পাদনা পরিষদের অবশ্যই আছে। শুনেছি, চাইনিজ রেস্তোরাঁর খাবার বর্জনেরও ডাক এসেছে, লকডাউনের কারণে এমনিতেই মানুষ বেরোতে পারছে না। কিন্তু আমি তো জানি ভারতেই হোক কি বাংলাদেশেই হোক আমাদের চাইনিজটা আমাদেরই, নামেই কেবল চাইনিজ; বর্জন করলে খাদ্য অর্থনীতির বারোটা বাজবে, এই সুযোগে চীন ভারতীয় স্বাদের প্যাকেটজাত চাইনিজ খাবার অর্ধেক দামে পাঠাতে শুরু করবে, লাদাখ ঢাকা এসব জিকিরে তা ঠেকানো যাবে না। পাদটীকা: একটি হোয়াটসঅ্যাপ বিজনেজ ইমেজ ভারতে সৃষ্ট হয়ে অনেক হাত ঘুরে সীমান্ত তোয়াক্কা না করে আমাদের অনেকের হাতে এসে পৌঁছেছে। ভারত-চীন সীমান্ত একটি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপর লোহার পাতে গাঢ় সবুজ এবং হালকা সবুজ রঙের কিছু একটা বাঁধছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তার মাথার ওপরের দিকটাতে লেখা : ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চীনের কুনজর থেকে ভারতকে রক্ষা করতে সীমান্তের কাঁটাতারে মন্ত্রপড়া লেবু আর মরিচ বেঁধে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, এই মন্ত্রে চীনের নজর যদি সরে গিয়ে থাকে মন্ত্রটা তো আমাদেরও শেখা দরকার। আমাদের সীমান্তে কখন কার নজর পড়ে! আনন্দবাজার, জি নিউজই সাহায্য করতে পারবে, বিনে পয়সায়, খয়রাতি মন্ত্র। খয়রাতিই। ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App