×

পুরনো খবর

মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি, পিছিয়ে আওয়ামী লীগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২০, ১২:৩৫ পিএম

মোহাম্মদ নাসিমের করোনাকালে করুণ বিদায় যেভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও তোপের মুখে পড়ল তাতে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশ তার আদর্শ নীতি আর পথ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। এ সমাজে মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।

সবসময় দেখলাম মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে। এবারো তার ব্যতিক্রম হলো না। বেশ কিছুদিন থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী হেভিওয়েট নেতা মোহাম্মদ নাসিম। একই সময় গণস্বাস্থ্যের প্রধান জাফরুল্লাহ চৌধুরীও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। আশ্চর্য তো নয়ই অবাকও হইনি যখন দেখলাম এক শ্রেণির মানুষ পাগল হয়ে একজনের মৃত্যু কামনায় আর একজনের জন্য দোয়া করার কাজে লেগে গেল। বলার দরকার নেই তারা কার মৃত্যু চাচ্ছিল আর কার নিরাময়? আমাদের দায়িত্ব না কারো অবদান মাপা বা কে বড় বা কে ছোট নির্ণয় করে দেয়া। কিন্তু আমরা এটুকু করি না একজনের জন্য কুৎসিত বদদোয়া আর একজনের জন্য শুভ কামনা।

বিনয়ের সঙ্গে জানতে ইচ্ছা করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি কখনো মন্ত্রী হয়েছিলেন? না দেশ বা সরকার পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন? যে মানুষ এমন বিষয়ে টেস্টেড না, আপনি কি করে তাকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন? কী করে নিশ্চিত হলেন তিনি কোনোভাবেই বিতর্কিত হতেন না? বলে রাখি গণস্বাস্থ্যের করোনা কিট নিয়ে বিতর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে তার হয়ে কথা বলেছি। সরকারের কঠোর সমালোচনা করতেও দ্বিধা করিনি।

আমাদের সমাজের কথা বলছিলাম। আওয়ামী লীগ এখন যে চেহারায় সে চেহারা কি পঁচাত্তরে ছিল? তখনো দেশ শাসন রপ্ত করতে পারেনি দল। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে যে মানুষটিকে দেশ মাথায় তুলে রেখেছিল একক সর্বজন প্রিয় নেতা বলে মেনে নিয়েছিল তাকে তারা কী করল? কী উপহার দিল? খুনিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি আমি তেমন কোনো বেপরোয়া সহানুভূতি দেখিনি। আজ এত বছর পর এসে এ কথা বলতেই পারি সেদিন বাঙালি মনে মনে কী ভেবেছিল জানি না বাইরে নীরব থেকে রক্তপাতকে মেনে নিয়েছিল বলেই; লাখো মানুষের জানাজা হতে পারেনি। এত বড় মানুষ ও নেতার দাফন হয়েছিল নীরবে অবহেলায়। কাপড় কাচার সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে রিলিফের কাপড় মুড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবের?

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আমরা বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে দেখলাম কয়েক মাস পরে নভেম্বর মাসে জেলখানায় নিহত হলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল কাণ্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জাতীয় নেতা মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। তাদের জানাজা হলেও মানুষ জানতে পারেনি। নিতান্ত অবহেলা আর তড়িঘড়ি করে দাফন কাজ শেষ করার ভেতর ছিল চরম ঔদাসীন্য। গত অক্টোবরে ঢাকায় বনানীতে থাকার সুবাদে এক দুপুরে আমি গিয়েছিলাম কবরস্থানে কবর দেখতে। আজো মনে হয় কী বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারাম আমরা।

এরা না থাকলে এই দেশ, এই পতাকা, এই মসনদ বা গাড়ি থাকত? ঢাকার যে বাড়ন্ত ফুলে-ফেঁপে ওঠা কোনোকালে ভেবেছিল বাঙালি? অথচ আমরা ইতিহাসের নীরব দর্শক হয়ে কী দেখলাম? মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার কীভাবে লাখো লাখো মানুষের কান্না আর অংশগ্রহণে বিদায় নিয়েছিলেন। সে দিন আমাদের জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম ছিল : Whom they brought her warrior dead. বলাবাহুল্য তিনিও মারা গেয়েছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে। তার লাশ নিয়েও আছে গল্প গাথা। আমার বাসা থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটার দূরত্বে সার্কিট হাউসে মারা যাওয়া জিয়াউর রহমানের লাশ প্রথমে চট্টগ্রামের অনতিদূরে এক গ্রামে দাফন করা হলেও পরে আবার তা তুলে এনে রাজধানীতে দাফন করা হয়। আমি বলব বিএনপির প্রতি মানুষের এই মৃত্যু-পরবর্তী ভালোবাসা বা উপচেপড়া সহানুভূতির কারণ রাজনীতি।

যে রাজনীতি পাকিস্তান ভাঙার বেদনায় আকুল সে রাজনীতি ক্রমেই ধারণ করেছে ভারতবিরোধী উগ্র চেহারা। আজ দেশে ভারত বিরোধিতা সংখ্যালঘু বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতা একাকার। সে রাজনীতি ভুলে গেছে মোহাম্মদ নাসিমের পিতা এ দেশের একজন ত্যাগী নেতা। মনসুর আলীর মতো সহজ মানুষ এখন রাজনীতিতে বিরল। অন্তত মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরিবারের অবদান যৌবনের শুরুতে নাসিমের পিতা হারানো কিছুই মনে রাখিনি আমরা। শুধু মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা বা মন্ত্রী মানেই দুর্নীতিপরায়ণ। দেশ বা সমাজে হাজার সমস্যা মানুষের চুরি-ডাকাতি বা মিথ্যার স্বভাব সব কিছুর জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ। আমি বলি না তারা তুলসী পাতা। বা সাফ। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো নাসিম কি একা পারতেন সামাল দিতে? না এটা একা কারো দ্বারা সম্ভব? আমি হলফ করে বলতে পারি স্বয়ং কোনো দেবদূতকে বসিয়ে দিলেও তিনি পারবেন না বাংলাদেশকে সঠিক পথে আনতে? সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মানুষের মগজের কোষে কোষে লোভ। আপনি সামাজিক মিডিয়াতেই দেখবেন মানুষ কতটা অসংযত লোলুপ আর সেক্স ক্রেজি। এটা কি রাজনীতি অবদান না আমাদের তৈরি? বিষয় যাই হোক রাজনীতিতে মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি এগিয়ে। এর কারণ বোঝা কঠিন কিছু নয়। এককালের মুসলিম লীগ, জামায়াত, রাজাকার এবং বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীলরা একজোট। ফাঁসি দিয়ে কয়েকজনকে সাইজ করা গেলেও এর বিস্তার রোধ করা যায়নি। এর জন্য কঠিনভাবে দায়ী আওয়ামী লীগ। বারবার গদিতে আগমন আর দেশ শাসনে এসেও তারা সময়ের সঠিক ব্যবহার করেনি। বরং যেখানে একটু প্রতিবাদ বা বিদ্রোহের আগুন সেখানেই সমঝোতার নামে ছাড়। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনাকে বলা হচ্ছে কওমি জননী। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমঝোতা কতটা নির্মম হতে পারে।

মোহাম্মদ নাসিমের করোনাকালে করুণ বিদায় যেভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও তোপের মুখে পড়ল তাতে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশ তার আদর্শ নীতি আর পথ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। এ সমাজে মৃত্যু-পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App