×

মুক্তচিন্তা

উতলা ব্যাংক : ব্যাঙ নিখোঁজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২০, ০৭:২৮ পিএম

এমডি, সিইও ধাঁচের কর্মকর্তাদের তিন-চারটা দামি গাড়ি ব্যবহারে লাগাম টানতে সমস্যা কোথায়? খেলাপি হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের চেষ্টাও কি করা যায় না? খেলাপি ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেয়াও কি কমেছে তেমন? ব্যাংক পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের ফি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমানো যায় না?

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় ব্যাংকে একদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ, আরেকদিকে ভর করেছে চাকরি হারানোর আতঙ্ক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের মাঝে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের অনেকে। করোনার ছোবলে প্রাণও গেছে কয়েক ব্যাংকারের। চাকরি হারানোর আতঙ্কে এখন মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটছে বেঁচে থাকা ফ্রন্টলাইনারদের অনেকের। ব্যাংকাররা ঝুঁকিতে, গ্রাহকরাও ঝুঁকিতে। এমন কঠিন সময়ে কেন ব্যাংক কর্মচারীদের টার্গেট করা হলো? করোনার ধকলে ব্যবসায় টান পড়ার অজুহাতে ব্যাংকারদের বেতনভাতা ১৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব কোথাও কোথাও সিদ্ধান্ত হিসেবে তামিল হয়েছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির উদ্যোগটি মড়ার উপর খাঁড়ার খায়ের মতো উতাল-অস্থির করে দিয়েছে ব্যাংকপাড়াকে। বাস্তব পরিস্থিতি বুঝেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সময় বেশি গড়াতে দেয়নি। ব্যাংকারদের কিছুটা স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছে। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত আপাতত থামিয়ে দিয়েছে বলা যায়। এর মাঝেই বেতন না কমিয়ে ব্যাংকের অন্য খরচ কমানোর বিষয়টিও এখন প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ ব্যাংক বেতনভাতা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেনি। বলেছে, ব্যাংকাররা যাতে উদ্যম না হারায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে। আশা করা যায়, এ যাত্রায় চাকরি ছাঁটাই থমকে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সময় না নিয়ে অতি গরজি হয়ে কেন এমন খেয়াল চাপলো ব্যাংক মালিকদের? তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-বিএবির চিঠিতে ব্যাংকারদের নানা সুবিধা বন্ধের পাশাপাশি ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতনধারীদের ১৫ শতাংশ করে বেতন কমানোর কথা বলা হয়েছে। সব ব্যাংক যাতে পহেলা জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, সেই পরামর্শ ছিল চিঠিতে। পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, প্রণোদনা বোনাস বন্ধ, নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা খোলা বন্ধ রাখার সুপারিশও করা হয়েছে। ব্যাংক খাত স্পর্শকাতর। যেনতেন সেক্টর নয়। অর্থনীতির অন্যতম অংশ। ব্যাংকে বেতন কমানো বা ছাঁটাই শুরু করলে স্তব্ধতা নেমে আসবে পুরো বেসরকারি খাতে। তা বুঝতে বড় অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। সংখ্যায় দেশে বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংক অর্ধশতের কাছাকাছি। নানা কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর মানুষের আস্থায় চির ধরেছে আরো আগেই। এর সিংহভাগ দায়ই মালিকদের। খরার টানের মধ্যেও মালিকরা বছরের পর বছর মুনাফা কমিয়ে নিচ্ছেন না। আনুষঙ্গিক সব ধরনের সুবিধাই হাতিয়ে নেন। বেনামে নানা সুবিধায়ও কমতি দেন না। তারও পর গত এপ্রিল থেকে সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করায় ব্যাংকগুলোর আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা পড়েছে। ধাক্কার মধ্যেই করোনার থাবা। এই ধাক্কা ও থাবার যোগফলে অনেক ব্যাংকের রিটেইল ঋণের ব্যবসা লাটে ওঠার দশা। এ কারণে খুচরা ঋণ বিভাগের লোকবল কমিয়ে খরচ কমানোর একটা চেষ্টা চলছে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। ছাঁটাই বা বেতন কমিয়ে তা কাটানো যাবে- এমনো নয়। বিহিত কিছু একটা করতেই হবে। কী হতে পারে সেই ব্যবস্থাটি? বিএবির চিঠিতে আরো কিছু বিষয়ও ছিল। বাজারে বা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে কেবল ছাঁটাই বা বেতন কমানোর উদ্যোগের কথাটি। ১৩ দফা সুপারিশ সংবলিত ওই চিঠিতে ছিল সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ ও আইটি পণ্য ক্রয় বন্ধ রাখা, কর্মীদের স্থানীয় ও বিদেশি প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখা, সব বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা, সব ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা খরচ ও অনুদান বন্ধ রাখা, পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখার কথা। এসব বিষয় আসলেই প্রাসঙ্গিক। আলোচনারও দাবি রাখে। ব্যাংক মালিকদের কখনোই কোনো ক্ষতিতে পড়তে হয় না। অনেক ব্যাংক পরিচালকের নিজস্ব ভবনে চড়া ভাড়ায় ব্যাংকের শাখা চালানোর ঘটনা ওপেন সিক্রেট। এ তথ্য ব্যাংকের পিয়ন-আরদালিদেরও জানা। সেসব ভাড়া সমন্বয় করলে কি ব্যাংকের খরচ বাঁচবে না? পরিচালকদের কাছেও নামে-বেনামে ব্যাংকের অনেক টাকা আটকে আছে। সেগুলো ফেরত আনলে কেবল লোকসান কমবে না, বিরাট অঙ্কের লাভও আসবে। আবার ব্যাংক থেকে টাকা মেরে খাওয়া রাঘব-বোয়ালদেরও চলতি পথে সমস্যা হয় না। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়াও এক ধরনের আভিজাত্য। হিম্মত। স্মার্টনেসের ব্যাপার। ক্ষমতাবান বলেই এমন ব্যক্তিত্বদের ঋণ পেতে সমস্যা হয় না। বরং তাদের টাকা পাইয়ে দিতে দিওয়ানা ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত। দাতা-গ্রহীতা দুপক্ষের সমঝোতাতেই ঘটছে ঘটনা। ব্যাংকপাড়ায় অস্থিরতার খরস্রোতে পড়ার অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণ। কিছু কিছু ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেরাই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে রেখেছেন। আগে তারা অন্য ব্যাংকের টাকা মারতেন। এখন নিজেরা ব্যাংক করে জনগণের টাকা মারার লাইসেন্সধারী। তারা যখন বছরের পর বছর প্রচুর প্রচুর মুনাফা করেছেন তখন কর্মীদের বেতন ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন? এখন মাস কয়েকেই ঘাটতি কমাতে কর্মীদের দিকে চোখ রাঙানি? ছাঁটাই ও বেতন কাটছাঁটে কোমর বেঁধে নামা? এমডি, সিইও ধাঁচের কর্মকর্তাদের তিন-চারটা দামি গাড়ি ব্যবহারে লাগাম টানতে সমস্যা কোথায়? খেলাপি হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের চেষ্টাও কি করা যায় না? খেলাপি ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেয়াও কি কমেছে তেমন? ব্যাংক পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের ফি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমানো যায় না? গেল বছর কয়েক সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক নিয়োগের সঙ্গে দলবাজ-দলদাসদের ব্যাংকের মালিক বানানোর ধুম পড়েছে। তা ঋণের নামে টাকা মারা এবং অনিয়ম-জালিয়াতিতে নতুন মাত্রা এনেছে। সে সঙ্গে বেড়েছে সেরের ওপর সোয়া সের দেয়ার কারসাজিও। আধিক্য বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বোঝাতে বাংলায় ব্যাঙের ছাতাকে উপমা হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন বেশ পুরনো। কিন্তু বাস্তবে ব্যাঙের ছাতার প্রতি এক ধরনের অবিচার। হালে ব্যাঙের ছাতা অমাবস্যার চাঁদের মতো। এর দেখা মেলে খুব কম। শহরে তো নয়ই। গ্রামেও খুব কম। এছাড়া ব্যাঙও বিলুপ্তির পথে। শিশুরা বই-পুস্তকে ব্যাঙের ছবি দেখে। ব্যাঙ বিষয়ে ছড়া, কবিতা পড়ে। কিন্তু জ্যান্ত ব্যাঙ দেখার সুযোগ হয় না সবার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাঙের সংখ্যা কমে গেছে। গবেষকরা বলছেন পাঁচ প্রজাতির ব্যাঙ গত ২০০ বছরে এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোলা ব্যাঙ, ভাউয়া ব্যাঙ, গাচ্ছা ব্যাঙ, ছাগল ডাকা ব্যাঙ, শূকর ডাকা ব্যাঙ, বামন ব্যাঙ, সবুজ ধানি ব্যাঙের নাম এখন শোনাও যায় না। ব্যাঙের ছানার মনের সুখে লাফানোর একটি ফুটেজ পেতে নানান জায়গায় দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও ব্যর্থ হতে হয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App