×

মুক্তচিন্তা

ক্ষমতার অবিরাম মাহাত্ম্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২০, ০৬:৪০ পিএম

ঢাকায় এখন পলিটিক্যাল পার্টি না থাকলে কি হবে, নানা ধরনের পার্টি বের হয়েছে। মলম পার্টি ও অজ্ঞান পার্টি আগেই ছিল, এখন যুক্ত হয়েছে সালাম পার্টি। অতি আপনজনের মতো, বিনয়-বিগলিত ভোটপ্রার্থীর অনুকরণে হাসি হাসি মুখ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, সালাম দেয় এবং তারপরেই সালামের মূল্যটি পরিশোধের দাবি জানায়। আক্রমণ করে। যা পারে ছিনিয়ে নেয়।

এই যে বিপুল পরিমাণ টাকা অনৈতিকভাবে পাপিয়া এবং এনু-রুপনদের হাতে চলে গেল এই টাকাটা কার? যতই মেধাবান হোক এরা নিশ্চয়ই টাকা তৈরি করেনি। টাকাটা আসলে জনগণের। আরো পরিষ্কার করে বললে মেহনতি মানুষের। যে মেহনতিরা দেশের থেকে এবং বাইরে গিয়ে মেহনত বিক্রি করে এ টাকা তাদের মেহনত ও ঘামে তৈরি। উৎপাদন তারাই করে। ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। কত কত টাকা যে চলে যাচ্ছে বিদেশে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফিন্যানসিয়াল সার্ভিসেস নামে একটি ব্যাংক জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা আমানত নিয়েছে, যেমনটা তাদের নেয়ার কথা। তারপর সেই টাকা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ কর্মকর্তারা মিলে-ঝুলে হাতিয়ে নিয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার নামের একটি চক্র একাই নাকি এত টাকা লুণ্ঠন ও পাচার করেছে যে শুনলে মাথা ঘুরে যায়। আমাদের তো ঘুরবেই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মাথাও ঘুরে গেছে। উচ্চ আদালতের রায়ে তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল। তিনি একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার, এক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এই ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভেতরে ঢুকে দেখেন, প্রশান্ত হালদার গং একক তৎপরতাতেই সরিয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেখে আতঙ্কিত অবস্থায় ২৫ দিন যেতে না যেতে তিনি পদত্যাগ করেছেন। সরকারের মঙ্গলকাক্সক্ষী বলে তিনি সুপরিচিত। সরকারকে তাই পরামর্শ দিয়েছেন গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর অবিলম্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে, নইলে নাকি মহাবিপদ ঘটবার সমূহ সম্ভাবনা। অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নয় তা আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যহ হাড়ে হাড়েই টের পেয়ে যাচ্ছি। নিরীহ পেঁয়াজ, তার ভেতরেও আগুন দেখেছি। চালের দাম বাড়ছে এবং কেন যে বাড়ছে তা কেউ বলতে পারছে না। এর আগে যিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি এসব কথা শুনলে হয়তো বলতেন রাবিশ, নয়তো ননসেন্স। সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়াকে তিনি বলতেন সামান্য টাকা। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও ক’দিন আগে বলেছিলেন অর্থনীতির অবস্থা চাঙ্গা। কিন্তু দুই দিন পরে তিনিই বলেছেন, না, অবস্থা ভালো নয়। প্রথম কথাটা ছিল বাইরে বলা, দ্বিতীয়টি সংসদে। অর্থমন্ত্রীকে সংসদে কথা বলতে গেলে কিছুটা সতর্কভাবেই বলতে হয়। প্রথম কারণ, সংসদে যে কোনো উক্তিই লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। সংসদে বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু না থাকুক, দরজার বাইরে ইতিহাস তো আছে। ইতিহাসের মোকাবিলা তো আজ হোক কাল হোক একদিন না একদিন কোনো না কোনোভাবে করতেই হবে। তাছাড়া অবস্থা যে ভালো নয় সে সত্য তো তার নিজের পদক্ষেপগুলোতেই উদঘাটিত। রাজস্ব সংগ্রহ সন্তোষজনক নয়; অথচ খরচ বাড়ছে তো বাড়ছেই। খরচ মেটানোর জন্য তাকে হাত পাততে হচ্ছে ব্যাংকের কাছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থও ছিনিয়ে নিতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিয়ে নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনযাপন সংকট বৃদ্ধিকরণ ঘটাতে হচ্ছে। এসব সত্যকে ঢাকা দেবেন কোন বাহারি উক্তির চাদর দিয়ে, শুনি? পারবেন না। পারছেন না। আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিপ্রিটি জানাচ্ছে যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে বছরে পাচার হয় এক লাখ কোটি টাকা। টিআইবি বলেছে পাচারের এ তথ্য আংশিক মাত্র, প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন দুর্নীতি ও বেসরকারি বিনিয়োগ না হওয়াটাই পাচারের মূল কারণ। একটু গভীরে তাকালেই কিন্তু দেখা যাবে আসল কারণ দেশপ্রেমের অভাব। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সাধারণ সত্য এটাই যে এই দেশে যে যত বেশি ধনী তার দেশপ্রেম তত কম। অবশ্য পুঁজিবাদী উন্নতির নিয়মই এটি। পুঁজির তো কোনো দেশ নেই, যেখানে মুনাফা, সেখানেই তার আস্তানা। তবে শুরুতে পুঁজিবাদীরা দেশপ্রেমিক ছিল এই পর্যন্ত যে তারা নানা দেশ থেকে লুণ্ঠিত ধন এনে নিজেদের দেশে জড়ো করত। দস্যু। তবে জাতীয়তাবাদী দস্যু বটে। পুঁজিবাদের শেষ যে ধাপটি থেকে আমাদের অগ্রযাত্রা, সেখানে দেশপ্রেম ঘাড়ের বোঝা হিসেবে পরিত্যক্ত। আর যদি দুর্নীতি বলেন তবে ৪ মার্চের খবর তো এই যে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল কয়লাখনি বড়পুকুরিয়াতে দেড় লাখ টন কয়লা চুরি গেছে বলে যে খবর বের হয়েছিল তাকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ কনজুমার্স এসোসিয়েশন। তারা বলেছে যে, চুরির পরিমাণ আসলে সাড়ে ৫ লাখ টন। আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব সাংবাদিকদের বেশ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি কথা বলছেন শোনা মাত্র সাংবাদিকরা মাইক্রোফোন ও নোট বুক নিয়ে হইহুল্লোড় করে তার কাছে ভিড় করতেন, স্মরণীয় মজার কিছু উক্তি পাওয়া যাবে এই আশাতে। তারা নিরাশ হতেন না। এ ব্যাপারে অন্য মন্ত্রীরা অতটা সক্ষমতার পরিচয় যে দিতে পেরেছেন তা হয়তো নয়। বড়-ছোট তো থাকবেই। তবে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী দেখলাম হাসি হাসি মুখ করে একটা কথা বলেছেন যা ভালো রকমেরই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন গাভী যদি কচুরিপানা খেতে পারে তবে আমরা কেন পারব না। ঘাসের কথা বলেননি। ঘাসের কথা বলে গেছেন পাকিস্তানের নামজাদা নায়ক জুলফিকার আলী খান ভুট্টো। ভুট্টো সাহেবের বক্তব্যটা ছিল প্রয়োজনে আমরা ঘাস খেয়ে থাকব তবু হিন্দুস্থানের সঙ্গে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। কাজটা অবশ্য তিনি শেষ পর্যন্ত করতে পারেননি, কারণ যাদের নিয়ে যুদ্ধটা চালাবেন ভেবেছিলেন তারা তার অতটা হম্বিতম্বি পছন্দ করেনি এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে তবে তাকে রেহাই দিয়েছে। আমাদের বিচক্ষণ পরিকল্পনামন্ত্রী ভুট্টোর মতো অলুক্ষণে কোনো কথা বলেননি, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন কচুরিপানা থেকেও খাদ্য উদ্ভাবন সম্ভব, সেটা করা যায় কিনা আমাদের ভেবে দেখা উচিত। সৎ পরামর্শ। কিন্তু এমনভাবে বলেছেন যে লোকে ভেবেছে তিনি খাদ্যাভ্যাস সম্প্রসারণের ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি খেয়াল করেননি যে ক্ষমতার জোরে মন্ত্রীরা যখন কোনো কথা বলেন অভাজন মানুষরা তখন তা শুনতে বাধ্য হয় এবং শুনে নানা রকমের অর্থ বের করে। মন্ত্রীরাই তো আমজনতার ভাগ্যবিধাতা; বিধাতাদের মুখের দিকে লোকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে জনতা এমনই ভুক্তভোগী যে দেবতাদের ওপর এখন তাদের বিন্দু পরিমাণ আস্থাও আর অবশিষ্ট নেই। সাবেক এক তথ্যমন্ত্রী (নিজেকে যিনি বামপন্থি বলে হাজির করতেন) অসাধারণ রকমের বাকপটু ছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয় বলে কোনো স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় উন্নত দেশে আছে বলে জানি না; তবে উপমহাদেশে বিলক্ষণ আছে। এই বিশেষ মন্ত্রণালয়ের কাজ মোটেই মানুষের জন্য অবাধ তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা নয়, উল্টো সেই অধিকার হরণ করা। আইয়ুব খানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন এই কাজে কেমন যে দুর্ধর্ষ ছিলেন তা লেখা আছে আমাদের ইতিহাসে। তিনি রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই উদ্যোগ অবশ্য তার প্রভু আইয়ুব খানের তুষ্টি বিধানের জন্যই নেয়া হয়েছিল, তবে মূর্খ প্রভুসেবকরা অনেক সময় যেমনটা অজান্তে যা করে থাকেন ইনিও তা-ই করেছিলেন, প্রভু আইয়ুব খানের পতনকে তিনি ত্বরান্বিত করে দিয়েছিলেন। সে যাই হোক, আমাদের সদ্য পদ হারানো তথ্যমন্ত্রীর অন্য দায়িত্ব কী কী ছিল আমরা জানি না। মন্ত্রী বলেছেন শহরের সুবিধাগুলো গ্রামে পৌঁছে দেয়া হবে। মন্ত্রী, কোন কোন সুবিধা? বায়ুদূষণে পীড়িত হওয়ার? ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকার? রাতের বেলা যেখানে-সেখানে দেহ কাত করে ঘুমানোর চেষ্টা করে পড়ে থাকার? ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার? মনে পড়ছে ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা ক’দিন আগে ছোট্ট একটু ঢেউ তুলেছিল। তারপর যথারীতি মিলিয়ে গেছে। পুকুরের পানি আবার আগের মতোই নিস্তরঙ্গ। ঘটনাটা এই যে গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসেছিলেন স্বামী-স্ত্রী, সঙ্গে দুই সন্তান। শহর দেখবেন। দেখেছেন। এবং দেখা শেষে একদিন খুব সকালে রওনা দিয়েছিলেন কমলাপুর রেল স্টেশনের দিকে, দুটি রিকশায় চেপে। পারলেন না। শহর দেখার সুখ গ্রামে নিয়ে যেতে পারলেন না। ছিনতাইকারীরা মোটরে করে এসে মহিলার ব্যাগ ধরে টান দিল। মহিলা শহরের প্রথা জানেন না। ব্যাগটা তাই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রাখলেন। ফল হলো হ্যাঁচকা টানে তিনি নিচে পড়ে গেলেন। তার মাথা ফেটে গেল। রক্তক্ষরণ ঘটল। তার রাজধানী সন্দর্শন সমাপ্ত হলো। শোনা যায় ঢাকায় এখন পলিটিক্যাল পার্টি না থাকলে কি হবে, নানা ধরনের পার্টি বের হয়েছে। মলম পার্টি ও অজ্ঞান পার্টি আগেই ছিল, এখন যুক্ত হয়েছে সালাম পার্টি। অতি আপনজনের মতো, বিনয়-বিগলিত ভোটপ্রার্থীর অনুকরণে হাসি হাসি মুখ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, সালাম দেয় এবং তারপরেই সালামের মূল্যটি পরিশোধের দাবি জানায়। আক্রমণ করে। যা পারে ছিনিয়ে নেয়। এসব সুখ দেখেই হয়তো ড্রাইভারদের কেউ হবেন, ট্রাকের পেছনে লিখে রেখেছেন দেখলাম, ‘চাচা, শহরে শান্তি নাই, চলো গ্রামে যাই’। শান্তি বানান করেছেন ‘ী’ কার দিয়ে। শান্তির কল্পনাটা বড় দীর্ঘই হবে তার কাছে। নানা ভাবে। সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসও মিশে গিয়ে থাকবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App