×

জাতীয়

বিদেশে বসেই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন মিঠু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২০, ০৯:৪০ এএম

বিদেশে বসেই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন মিঠু

মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখন একেবারেই খারাপ সময় পার করছে। অতীতের লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ খাতটি। করোনাকালেও থামেনি অপকর্ম-অনিয়ম। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এখন সোনার হরিণ। স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে পুরো স্বাস্থ্য খাত। আর এই সিন্ডিকেটের নেপথ্য নায়ক এই খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। প্রায় সাত বছর ধরে পর্দার আড়ালে থেকে নাড়ছেন নিজের গড়া সিন্ডিকেটের কলকাঠি। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে পালিয়ে থেকেও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সব কিছুই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জানা যায়, মিঠুর লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেড় যুগ ধরে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ সময়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। নিজের নামে ১৫-১৬টি প্রতিষ্ঠানসহ সহযোগীদের নামে থাকা ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে চলত এসব দুর্নীতির মচ্ছব। মিঠুর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, মিঠু বর্তমানে আমেরিকা ও সিঙ্গাপুর যাতায়াত কওে সেখান থেকেই বাংলাদেশে তার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। তার মূল প্রতিষ্ঠান লেক্সিকনের ঠিকানা পরিবর্তন করে গুলশানে নেয়া হয়েছে। তার এই অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যেই। সেই সঙ্গে তার পুরনো যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিয়ে অন্য নামে আরো কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন বলেও ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের একাধিক সূত্র জানায়, মিঠুর এক সময়ের ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী আবজাল ও তার স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ আয় ও সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে দ্ব›দ্ব শুরু হলে ফাঁস হয়ে যায় ওই দম্পতির প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিকানার বিষয়টি। দুদক ওই সূত্র ধরেই একে একে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তরের ৪৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শুরু করে। পরে পর্যায়ক্রমে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। কয়েকজন গ্রেপ্তার হন, কেউ কেউ বদলি হন। ওই পরিস্থিতিতেও দেশের বাইরে থেকে নিজের সিন্ডিকেটের লোকজনকে যতটা সম্ভব সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন মিঠু। সক্রিয়ভাবে চলতে থাকে তার সিন্ডিকেটের কার্যক্রম। অভিযোগ রয়েছে, এ ক্ষেত্রেও বর্তমান একজন মন্ত্রীর ছেলেকে হাত করে সিন্ডিকেট সক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আর এর পরই সিন্ডিকেটের ভেতরে থাকা বিভিন্ন ঠিকাদার, কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এক ধরনের ভাঙা-গড়া তৈরি হয়। পুরনো অনেককেই বাদ দিয়ে জায়গা দেয়া হয় নতুন অনেককে। শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীই নন, তার পুরনো বিশ্বস্ত সহযোগী ঠিকাদারদের মধ্যে যারা তার বিরোধিতা করেছেন তারাও বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছেন। এ ক্ষেত্রে স¤প্রতি যে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই তালিকার মধ্যে যেমন মিঠু বা তার প্রতিষ্ঠানের নাম নেই, তেমনি যাদের নাম আছে তাদের অনেকেই আগে মিঠুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বা একই সিন্ডিকেটে থাকলেও কোনো কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জন প্রশাসন সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার মিঠু কীভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই তথ্যও চিঠিতে জানিয়েছেন তিনি। দুদক সূত্রে জানা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেছিল দুদক। স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও তার নামে-বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠানো হয়। একই সঙ্গে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মিঠুকে তার সহায়-সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেয়া হয়েছিল দুদক থেকে। এর পর রহস্যজনক কারণে তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে যায়। ২০১৬ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে দুদক যে চিঠি পাঠিয়েছিল তাতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন উন্নয়ন, সেবা খাতে যে সমস্ত কাজ বাস্তবায়ন করেছে, চলমান আছে এবং ওষুধ-মালামাল-যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোর প্রশাসনিক অনুমোদন, বরাদ্দপত্র, প্রাক্কলন- টেন্ডার, কোটেশন, দাখিলকৃত টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কার্যবিবরণী, কার্যাদেশ, কার্যসমাপ্তি প্রতিবেদনসহ প্রাষঙ্গিক সব রেকর্ডপত্র ২০১৬ সালের ৩০ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু পরে কয়েক দফা তাগিদ দেয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসব রেকর্ড আর দুদককে দেয়া হয়নি। পরে অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত আর এগোয়নি। বরং চিঠি চালাচালিতে বিষয়টি ধামচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। পরে দুদকও আর মিঠুর বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে প্রায় চার বছর ধরে তার দুর্নীতির তদন্ত থেমে আছে। কথিত আছে, স্বাস্থ্য খাতের মতো দুদকেও রয়েছে মিঠুর শক্তিশালী একটি চক্র। সরকারের অন্য সেক্টর থেকে প্রেষণে আসা দুদকের এক ক্ষমতাধর পরিচালকের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা। দুদকের এই চক্রই মূলত তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। প্রশাসন ক্যাডারের এই পরিচালকই নেপথ্যে মিঠুর পক্ষে কাজ করছেন এবং মিঠুর সমস্ত ফাইল তিনি ধামাচাপা দিয়ে রাখছেন। এই পরিচালকের কারণেই দুদক মিঠুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দুদকের এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে এখনো মিঠুর যোগাযোগ রয়েছে বলে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার গোপনীয় একটি অনুসন্ধানে জানা গেছে। এদিকে মিঠু সিন্ডিকেটের বিষয়ে মুখ খুলেছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। রবিবার এক ভিডিও বার্তায় সরকারের কাছে ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, বাংলাদেশের তিন-চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ লাখ কিট এনে রেখেছে। কিন্তু তারা তা দিতে পারছে না মিঠু সিন্ডিকেটের কারণে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ যতক্ষণ পর্যন্ত ভাঙা না যাবে, ততক্ষণ এই মন্ত্রণালয় কখনো ভালো থাকবে না। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি পুরো স্বাস্থ্য বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, সরকারের প্রতিটি অঙ্গই বর্তমানে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের মতো দুদকেও মিঠুর সিন্ডিকেট থাকাটা উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশার বিষয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App