×

মুক্তচিন্তা

বন্যপ্রাণীর প্রতি সহিংসতা কবে থামবে?

Icon

nakib

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২০, ০৮:৪৫ পিএম

দেশ দুনিয়ায় বন্যপ্রাণীরা ভালো নেই। করোনার আগে কী করোনাকালে। কিন্তু করোনা-উত্তর সময়ে কী হবে বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ? তবে আশা আছে, কারণ ভালোবাসা আছে। এই করোনাকালেও মানুষ রাস্তাঘাটের কুকুর, বিড়াল, কাক, পাখি, বানরের জন্য খাবার নিয়ে গেছে মুখে মাস্ক বেঁধে।

বন্যপ্রাণী হত্যার সব খবর সবসময় গণমাধ্যম কী সামাজিক মাধ্যমে আসে না। সব ঘটনায় বন বিভাগ কী আদালতের সক্রিয়তাও থাকে না। করোনাকালে বাংলাদেশে সংগঠিত বন্যপ্রাণী হত্যার প্রকাশিত খতিয়ান দিয়ে চলতি আলাপখানির বিস্তার হয়েছে। এগুলো সবই সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছে। মানুষ নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সক্রিয়তা দেখিয়েছে। প্রকাশিত এসব খবর বিন্যস্ত করে দেখা যায় গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর এই মধ্য জুন অবধি ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করেছে মানুষ। বন্যপ্রাণীর প্রতি এমন সহিংসতা নতুন কিছু নয়, কিন্তু চলতি আলাপখানি আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চায় করোনাকালের কথা। যখন চারদিকে লকডাউন চলছে, বৈশ্বিক মহামারিতে থমকে আছে জগৎ। মানুষ যখন নিজে বাঁচতে লড়ছে তখন এই মানুষ কেন অন্য জীবের প্রাণ হরণ করতে উন্মত্ত? আর বন্যপ্রাণীর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা, বৈশ্বিক চোরাচালান কী বন্যপ্রাণীর বাজার কীভাবে আমাদের জন্য বারবার নানা অসুখ আর মহামারি ডেকে আনছে, তা এই আলাপে টানছি না। ‘করোনাকালে বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা প্রশ্ন’ নিয়ে এপ্রিলের প্রথমেই প্রকাশিত লেখাগুলোতে সেসব স্পষ্ট করেছি। কেবল খুনিদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি করোনা মহামারিও একটি প্রাণীবাহিত রোগ। বন্যপ্রাণী থেকেই এর বিস্তার ঘটেছে। তবে বন্যপ্রাণীর প্রতি এই চলমান সহিংসতার এক প্রতিবেশগত-সামাজিক বিশ্লেষণ আমি দাঁড় করাচ্ছি।

৩১ মার্চ : গলা টিপে বানর হত্যা, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার বানরদের জঙ্গল দখল করে বহিরাগত বাঙালিরা একটি পাড়া তৈরি করে নাম দিয়েছেন কুমিল্লাপাড়া। পাশের জঙ্গল থেকে শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর ইউনিয়নের পশ্চিম লইয়ারকুল গ্রামের এই কুমিল্লাপাড়ায় আসে একটি বানর। বানরটিকে ধরে গলায় লোহার তার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কুদ্দুস মিয়া, জামাল মিয়া ও সাহেব আলী। বন বিভাগ এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের ৬ এবং ৩৯ ধারায় উল্লিখিত তিন হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ৫ এপ্রিল।

৪ এপ্রিল : নিথর ডলফিন, টেকনাফ, কক্সবাজার লকডাউনে পর্যটকের শোরগোল না থাকায় সমুদ্র সৈকতে ডলফিনসহ প্রাণীরা হুল্লোড়ে মাতলেও নানাভাবে মানুষ হত্যা করছে তাদের। ৪ এপ্রিল কক্সবাজারের টেকনাফের শামলাপুরের সৈকতে এক জখমপ্রাপ্ত ডলফিনের লাশ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বলেছেন, জালে আটকে পিটিয়ে একে হত্যা করা হয়েছে। যদিও বন বিভাগ গণমাধ্যমে দুই রকমের বক্তব্য দিয়েছে। বলেছে, ঘটনাটি তাদের জানা নেই এবং এটি জালে আটকে মরে ভেসে এসেছে, কেউ মারেনি।

৫ মে : বিষে নিহত ১৫ বানর, পৌরসভা, মাদারীপুর মাদারীপুরের চরমুঘরিয়া দেশের এক অনন্য বানর বিচরণ অঞ্চল। মাদারীপুর পৌরসভার মধ্যখাগদি এলাকায় কিছু অপরিচিত যুবক ৫ মে চিঁড়া, মুড়ি, কলা বানরদের খেতে দিয়ে চলে যায়। বিষ মেশানো ওই খাবার খেয়ে নাকে-মুখে রক্তবমি হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১৫টি বানর। পুলিশ বানরগুলো উদ্ধার করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় সামাজিক বন বিভাগ মামলা করে এবং পুলিশ শাহনাজ বেগম নামের এক অভিযুক্ত হত্যাকারীকে আটক করে।

৯ মে : রক্তাক্ত ডলফিন, হালদা নদী, রাউজান, চট্টগ্রাম ছোট্ট এই দেশ এখনো ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। হালদার ৪৫টি ডলফিনের ভেতর ২০১৭ থেকে এখন অবধি মৃত্যু ঘটেছে ২৪টির। করোনাকালে নিহত হয়েছে আরো দুটি। ৯ মে হালদা নদীতে রক্তাক্ত এক ডলফিনের লাশ ভাসতে দেখা যায়। করোনাকালে লকডাউনে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হওয়ার পর প্রথম এই ডলফিন হত্যার বিচার চেয়ে ১১ মে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট করেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন। হাইকোর্ট এ ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

২৯ মে : মেছোবাঘ-বেজি ও শিয়াল হত্যা, জৈন্তাপুর, সিলেট প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জলমগ্ন হলে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকার টিকে থাকা শেষ বন্যপ্রাণীরা জীবন বাঁচাতে ‘লোকালয়ে’ আশ্রয় নেয়। পরিহাস হলো এসব লোকালয় মাত্র কিছু বছর আগেও বন্যপ্রাণীদেরই ছিল। ছিল ‘মেছোবাঘালয়’ বা ‘বেজিলয়’। বৃষ্টির পানির কারণে জৈন্তাপুরের ফতেহপুর ইউনিয়নের বালিপাড়া গ্রামে ২৯ মে কিছু বন্যপ্রাণী আশ্রয় নেয়। গ্রামের আবদুল হালিম ও শাহরিয়ার আহমদসহ আরো কয়েকজন মিলে দুটি মেছোবাঘ, ছয়টি শিয়াল ও একটি বেজি খুন করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বন বিভাগ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

৩০ মে : বুলবুলি পাখির মৃত্যুদণ্ড, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ বছর বছর লিচুর জন্য প্রশ্নহীনভাবে পাখি ও বাদুড় হত্যা করছে বাগান মালিকরা। লিচুতে দেয়া বিষে মরছে শিশুরাও। ঝিনাইদহের শৈলকুপার ত্রিবেণী ইউনিয়নের কুঠিপাড়া গ্রামের লিচুবাগান মালিকরা লিচুবাগানের চারধারে নিষিদ্ধ ‘কারেন্ট জালের’ ফাঁদ ব্যবহার করেন। জালের সুতায় নখ, ঠোঁট ও পাখা আটকে ৩০ মে নির্মম মৃত্যু হয় অজস্র বুলবুলি ও শালিক পাখির।

৯ জুন : মাছরাঙার শিরোñেদ, তালতলী, বরগুনা গাছের কোটরে ডিমে তা দিচ্ছিল মাছরাঙা পাখিটি। ৯ জুন সন্ধ্যায় বরগুনার তালতলীর কামরুজ্জামান ফারুক কোটর থেকে মা পাখির মাথা কেটে হত্যা করে ডিমগুলোও উচ্ছেদ করে। এ ঘটনায় সাগর কর্মকার বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে বাদী হয়ে মামলা করেন। হত্যাকারীকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তিনি উপজেলা ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

৯ জুন : ডাহুক গণহত্যা, সদর, ফরিদপুর ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের শওকত ফকির একজন ‘বুনোপাখি বিক্রেতা’। ধনীরা এসব খেতে আর বন্দি করে পালতে চায় বলেই এই শওকত ফকিররা হয়তো এসব ধরে বিক্রি করেন। ৯ জুন ৫০টি ডাহুক ধরে হত্যা করেন শওকত ফকির। ১০ জুন ম্যাজিস্ট্রেট অরুপ কুমার বসাক এই গণহত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেন। খুনিকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

১২ জুন : টেকনাফ, কক্সবাজার বাংলাদেশে এশীয় হাতির বিচরণ অঞ্চলের একটি কক্সবাজারের টেকনাফ। মায়ানমার থেকে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা হাতি চলাচলের পথগুলো দখল করে নিলে শুরু হয় আরেক সংকট। হাতির চলাচলের এখন না আছে রাস্তা না আছে এলাকা। এছাড়া মানুষ নানাদিকে বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে রেখেছে। এতে গত পাঁচ মাসে চারটি হাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। ১২ জুন সকালে টেকনাফের হ্নীলার পশ্চিম পানখালীর খণ্ডাকাটা এলাকায় একটি বুনো হাতি পাহাড় থেকে নেমে বসতির দিকে যাচ্ছিল। চলতি পথে খণ্ডাকাটা গ্রামে মরিচ্যাঘোনা থেকে টানা বিদ্যুতের তারে শুঁড় জড়িয়ে মারা যায় হাতিটি। হাতিটির মৃত্যু তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে বন বিভাগ।

নিষ্ঠুরতার ব্যাকরণ চুরমার হোক ওয়াইল্ডলাইফ জাস্টিস কমিশন ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণীর চোরাচালান নিয়ে ২০১৬ সালে শুরু করা তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে করোনাকালে। প্রতিবেদনে ঢাকাকে বৈশ্বিক কাছিম ও কচ্ছপ চোরাচালানের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত দল বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানালে ঢাকার একটি সেফ হাউস থেকে ঘড়িয়ালসহ ৬২০টি বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। তার মানে দেশ দুনিয়ায় বন্যপ্রাণীরা ভালো নেই। করোনার আগে কী করোনাকালে। কিন্তু করোনা-উত্তর সময়ে কী হবে বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ? তবে আশা আছে, কারণ ভালোবাসা আছে। এই করোনাকালেও মানুষ রাস্তাঘাটের কুকুর, বিড়াল, কাক, পাখি, বানরের জন্য খাবার নিয়ে গেছে মুখে মাস্ক বেঁধে। করোনাকালে নিষ্ঠুরতাও ঘটেছে চরম, বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালোবাসার নজিরও কম নয়। ভারতের কেরালায় আনারসে বোমা ভরে গর্ভবতী হাতি খুন কী বাংলাদেশের মাদারীপুরে বিষ দিয়ে বানর হত্যার ছবি কার না কলিজাকে কাঁপিয়েছে? প্রতিজন মানুষ তার নিজের বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই বন্যপ্রাণীর প্রতি তার সম্পর্কের গাঁথুনিকে মজবুত করতে পারে। আর করোনাকাল এই অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারের এক বিশেষ সময়।

পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App