×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালের অর্থনীতি ৩

Icon

nakib

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২০, ০৯:১৩ পিএম

মোনালিসা বেচে দেয়ার প্রস্তাব আগেও এসেছে। রহস্যময় হাসির এই ছবি আহামরি সুন্দর নয়- এমন একজন নারীর ছবি এত প্রহরা বসিয়ে বছরের পর বছর ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরের গ্যালারিতে ঝুলিয়ে রেখে কী লাভ? করোনাকালে নগদ টাকার সংকটে ফ্রান্স যখন হাঁসফাঁস করছে, প্যারিসের ডিজিটাল কনসালটেন্ট স্তেফানি দিস্তিঙ্গুইন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন আরব রাজকুমারদের কারো কাছে ছবিটি অন্তত ৫০ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিলে এই সংকটের সময় হাতে টাকা আসে এবং সরকার টাকাটা শিল্প-সহায়তায় ব্যয় করতে পারে।

অর্থনীতি কি ফ্রিজ করে রাখা যায়? রাজনৈতিক ভাষ্যকার ম্যাট ওয়ালশ করোনাকালের অর্থনীতি নিয়েও মাথা ঘামালেন। বললেন, মানুষ আসলে ভাবে সরকার চাইলে অর্থনীতিকে জাদুবলে ফ্রিজ করে গরুর মাংসের চাকা বানিয়ে রেখে দিতে পারে। ক’মাস পরে সুযোগ এলে আবার বরফ ছাড়িয়ে নিতে পারবে। এটা তেমন কিছু নয়। এতে কিছুটা মূল গন্ধ কমে যেতে পারে। বাস্তবে ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়, এভাবে হয় না। সরকারের কোনো জাদু নেই। সরকার হস্তক্ষেপে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকার তা পুনরুদ্ধার করতে পারে না। ম্যাট ওয়ালশ অবশ্য পাশ্চাত্যের ধনী দেশের সরকারের কথা এবং সেখানকার অর্থনীতির কথা বলেছেন। সেখানে শিল্পোদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের এজেন্ট পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকেন সরকার যেন নিজের কাজ ভুলে বাজারের কাজে নাক না গলায়। তাতে বাজার বিকৃত হয়। চাহিদা ও জোগানের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। বাজারের প্রকৃত বিকাশ না ঘটায় বাংলাদেশের মতো দেশে রাষ্ট্রকে এবং জনগণের সম্পদ রক্ষার গ্যারান্টি দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারি করতে হয়। বিশেষ করে বিশ্বব্যাধির মতো সংকটকালে যখন অর্থনীতিবিদরাও সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে বলতে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে রাষ্ট্রকেই আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিতে হয়।

অর্থনীতিবিদদের হিমশিম খাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অস্বাভাবিক দ্রুতিতে অর্থনীতির পতন। (সে সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উৎসাহ জোগানো এবং কর্মচ্যুতি ঠেকানোর ওয়াজ-নসিহত কোনো কাজে আসে না); ভালো সামষ্টিক অর্থনৈতিক মডেল তৈরির যে প্রাথমিক উপাদান তা হচ্ছে উপাত্ত, বিশ^ব্যাধির কারণে উপাত্ত নিম্নমানের হয়ে পড়ে (করোনা ভাইরাসে বিশ্ব যখন আক্রান্ত এ সময় জরিপ ফর্ম যিনিই পূরণ করুন না কেন তার মানসিক অবস্থা ও আবেগ প্রতিফলিত হবে এতে, ফলে গুণমান সম্পন্ন উপাত্ত নিয়ে কাজ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে); তাছাড়া এখানে অর্থনীতিবিদকে কাজ করতে হচ্ছে তার অজানা-অচেনা রোগতত্ত্বের একটি জগতে যেখানে এমনকি স্বাস্থ্য পরামর্শকরাই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকছেন। আবার সরকারের ভুল হস্তক্ষেপ যে মন্দার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে দুই মহাযুদ্ধের মাঝখানে মহামন্দা- দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন সে সাক্ষ্যই দেয়। বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফরাসি সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপই মার্কেট ক্রাশ, গণভোগান্তি এবং শতাব্দীর দীর্ঘতম অচলাবস্থার জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ হস্তক্ষেপ, ফেডারেল রিজার্ভের ভুল মুদ্রাস্ফীতি নীতি, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর মন্টেগু নরমানের একচোখা মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, ফরাসি সরকারের স্বর্ণসঞ্চয় লালসা বিশে^র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অর্থব্যবস্থাপনায় গভীর ক্ষত রেখে যায়। সুতরাং করোনা ভাইরাসের বিশ^রাজত্বে সরকারনির্ভর দেশগুলোতে সরকারের সঠিক নীতি ও নির্দেশনা যে কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে, অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপ ক্ষতি করতে পারে তার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার তিন মাস পার হয়ে গেছে। দেশে করোনা শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত তা প্রতিদিনই ঘটা করে আমরা জানি, আমাদের জানানো হয়। গণিতের সামান্য হিসাব যারা জানেন, তারাও জানেন, রিচুয়াল হিসাবে এ তথ্য পরিবেশন করা হয়; যদি পরীক্ষার সংখ্যা দশগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে করোনা শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যাও দশগুণ বাড়বে, তিন হাজারের জায়গায় তিরিশ হাজার। ভাইরাস প্রবাহের প্রথম তরঙ্গ, দ্বিতীয় তরঙ্গ, তৃতীয় তরঙ্গের কথা শুনছি। কোনো কোনো দেশ সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় তরঙ্গেও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের প্রথম তরঙ্গ কি শেষ হয়েছে? অর্থনীতি ফ্রিজ করে রাখা যায় না যে ডিফ্রস্ট করে আবার গরম করা হবে। সুইচড অফ অর্থনীতি রিস্টার্ট করা হয়েছে, সঙ্গত কারণেই শ্রমিক ছাড়া আর সব উপাদানেই ঘাটতি থাকবে। ঘাটতি বাজেটই হওয়ার কথা- করোনা ভাইরাস আমাদের রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর এবং স্বাস্থ্য খাতের সে ভয়ঙ্কর অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্রটির সামনের পর্দা সরিয়ে নিয়েছে মেরামতের শুরুটা সেখান থেকেই হোক, মহাকাশ প্রতিরক্ষা, অনুৎপাদনশীল শিক্ষা এবং ঠিকাদারবান্ধব প্রকল্প বরং কিছুকাল দূরেই থাকুক। করোনাকালের দুঃস্মৃতি ভোলাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হতে হবে জনকল্যাণ এবং প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।

করোনা দারিদ্র্যে ৮ কোটি ৬০ লাখ শিশু ইউনিসেফ যে হিসাব দিয়েছে তাতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় দরিদ্র শিশুর মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৭ কোটি। করোনার সরাসরি আঘাতে ৮ কোটি ৬০ লাখ, যেখানে দরিদ্র শিশুর সংখ্যার উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটার কথা সেখানে যোগ হয়েছে আরো ১৫ শতাংশ। তাদের পড়াশোনার ক্ষতির কথা বাদই থাকুক, টিকে থাকার জন্য যে কামাইটুকু তাদের অনিবার্য ছিল, কর্মচ্যুতির তালিকায় তারাই প্রথম দিককার শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮৮ সালের পর ৩২ বছরে এই প্রথমবারের মতো দারিদ্র্য আবার বাড়ছে। ২০০৬ থেকে ২০১৬ এই সময়ে ২৭১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল; লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছিল বাংলাদেশে- এ সময় দারিদ্র্য রেখা ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন। ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষও বিদায় নিতে চলেছিল, সমস্যা ছিল বণ্টনে। কিন্তু করোনাকালে আবার দারিদ্র্যে পতিত হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন- ৫০ কোটি মানুষ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি এবার স্পষ্টভাবে পুরনো কথাটাই বলেছেন, একবার দারিদ্র্যে পতিত হলে এখান থেকে উত্তরণ সহজ নয়। বিশ্বব্যাংক হিসাব দিয়েছে এদের মধ্যে ৬ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যে পতিত হবে। এই দারিদ্র্যের বোঝা পৃথিবীকে অনেকদিন বইতে হবে যদি না সরকার এখনই দারিদ্র্যকেন্দ্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। জনস্বাস্থ্য সেবার বৃহদাংশ পাচ্ছে ধনী মানুষ, ফলে বৈষম্য এখানেও বাড়ছে। মশক নিধন কর্মসূচিতে মশা মারা হয় মন্ত্রী-সচিবসহ ধনবান মানুষের এলাকায়। ওষুধ মশক সৃষ্টির উৎস যেখানে সেখানে পৌঁছে না, দরিদ্রের বাসস্থানের চারপাশে কোথাও না এ ওষুধ ছিটানো হয় না, যদি চাপে পড়ে যেতে হয়, তাহলে সিলিন্ডারে থাকে নোংরা পানি। লাতিন আমেরিকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় নেমে গেছে গড়পরতা ১৫ ভাগ, এটা করোনা সংক্রমণের আগের হিসাব। এখন বৈষম্য আরো বেড়েছে। যে দেশেই হোক নীতিনির্ধারক এবং সরকার ৩২ বছরের অর্জনকে পুনরুদ্ধার করবে না আরো বিনষ্ট করবে সেটা দেখার বিষয়। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তি খাতের ব্যবসায়ী-ক্রীড়নক হয় তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে আরো ভোগান্তি রয়েছে।

তুলনামূলক ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের হিসাব পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, ভবিষ্যৎ বীক্ষণে ভ্রান্তির নজির নিয়ে পৃথক রচনা প্রণয়ন করা যেতে পারে তবে বাংলাদেশের করোনা বছরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে সর্বশেষ যে হিসাব দিয়েছে তাতে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম মন্দ অবস্থানে রয়েছে।বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হবে ২.৭ আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ১.৬ শতাংশ, যদিও সরকার দাবি করছে ৫.৪ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাবে, বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকোচন ঘটবে ৫.২ শতাংশ । যারা ১৯২৯-এর দীর্ঘমেয়াদি মহামন্দার চেয়ে বড় মন্দার আশঙ্কা করেছিলেন নতুন করে হিসাব কষতে বসেছেন এবং মন্দার সংজ্ঞাও আবার বিশ্লেষণ করছেন। অর্থনীতির বন্ধ দুয়ার এমনকি এখনই প্রবল করোনাক্রান্ত দেশগুলোতে খুলে গেছে। চীন ‘রোড টু রিকভারি’তে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে, জাপান করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সড়কে এর মধ্যেই পা রেখেছে। তেলের চাহিদা বাড়ছে, অশোধিত তেলের দাম অতলান্তের মাইনাস থার্টি সেভেন থেকে উঠে এসে প্লাস থার্টি সেভেন অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সমীক্ষা স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছে করোনা পূর্বকালে যে আয় বৈষম্য ছিল করোনাকাল তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যে রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণের জন্য কাজ করে তার অন্যতম দায়িত্ব আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির পরিচালকদের সরকারপন্থি পরিচিতি থাকার পরও তারা যখন বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন, এ কথাকে বিরোধী দলের বিভ্রান্তি প্রচার বলে সরকারের উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।

চৌচির আকাশে নতুন এয়ারলাইন্স বেসামরিক বিমান পরিবহনের ইতিহাসে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি এত বড় আঘাত কখনো পায়নি। যেখানে চলতি বছর বিশ্বজুড়ে এয়ারলাইন্সগুলো অন্তত ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাভ করত, সেখানে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশন (আইএটিএ) ক্ষতির হিসাব দেখিয়েছে ২৬২ বিলিয়ন ডলার। এয়ারলাইন্সগুলোর ওপর আকাশ ভেঙে পড়া বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে বেশি কিছু ঘটে গেছে। দেউলিয়া হয়ে গেছে ক’টি লেগাসি ও লো-কস্ট এয়ারলাইন্স। দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে বেশ ক’টি। বার্কশায়ার-হ্যাথওয়ের চেয়ারম্যান ওয়ারেন বাফেট যখন চারটি আমেরিকান এয়ারলাইন্স- ইউনাইডেট আমেরিকান, সাউথওয়েস্ট এবং ডেল্টা এয়ারের শেয়ার কম দরে ছেড়ে দিলেন আতঙ্ক আরো ছড়িয়ে পড়ল। শেয়ারবাজারের জাদুকরের পরিচিতি যার তার তো ভুল করার কথা নয়। সংকট আরো ঘনীভূত হবে জেনে নিশ্চয়ই বিমান পরিবহন থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু জাপানের নতুন এয়ারলাইন্স জিপএয়ার ৩ জুন প্রথম নারিতা-টোকিও ফ্লাইটের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে। যাত্রীবাহী হওয়ার কথা থাকলেও যাত্রীর জন্য দুদিনের এয়ারপোর্টের পূর্ণ প্রস্তুতি না থাকায় কার্গো হিসেবে এখন আসা-যাওয়া করছে। জিপএয়ার জাপান এয়ারলাইন্সের একটি সাবসিডিয়ারি। দুর্যোগের মধ্যেও এভিয়েশন ব্যবসায়ীরা আশাবাদী চৌচির আকাশে জোড়া লাগবে, যে কোনো সময় আকাশে থাকবে অন্তত ৫ হাজার উড়োজাহাজ।

একটানা ২৯ বছর পর গত শত বছরে একটানা ২৯ বছর ধনাত্মক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার রেকর্ড অস্ট্রেলিয়ার। সময়ের বিচারে এটাই পৃথিবীর দীর্ঘতম অর্থনৈতিক সাফল্যের রেকর্ড। কিন্তু করোনাকালের লকডাউন এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রবৃদ্ধি এতটাই সঙ্কুচিত করেছে যে অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় প্রবেশ করেছে। অস্ট্রেলীয় সরকারের কোষাগার প্রধান শিকার করেছেন জানুয়ারি-মার্চ কোয়ার্টারের চেয়েও বেশি সঙ্কুচিত হবে এপ্রিল-জুন কোয়ার্টারের অর্থনীতির আকার। ডমেস্টিক কনজাম্পশন বা গার্হস্থ্য-ভোগ কমে গেছে। পোশাক, যানবাহন, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, হোটেল, বিনোদনে ব্যয় পতন ঘটেছে। বেকারত্ব বেড়েছে ৬.২ ভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে জুনের মধ্যে তা বেড়ে ১০ ভাগে পৌঁছবে এবং ২০২১-এর অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পরও তাদের সবার কর্মসংস্থান হবে না। ১৯টি ধনী দেশের আর্থিক কার্যক্রমের পরিসংখ্যানে একমাত্র সুইডেনকেই প্রথম তিন মাসে অর্থনীতির আকার কিছুটা বাড়াতে দেখা গেছে। ভালো বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানেই অস্ট্রেলিয়া, অর্থনীতির আকার সঙ্কুচিত হয়েছে মাত্র ০.৩ ভাগ; বাকি ১৭টি দেশের গড় সংকোচন ২.৯ ভাগ। ঘুরে দাঁড়াতে অস্ট্রেলিয়া পরিকল্পিতভাবে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশীয় অর্থনীতিতে প্রবিষ্ট করাচ্ছে, এর বৃহদাংশ ব্যয় হবে গ্রিন ইকোনমির পথ ধরে। ন্যূনতম বেতন ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে ১৯ ডলার সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এতে উৎপাদনশীলতা যেমন বাড়বে, শ্রমিকদের সম্মানজনক জীবনযাপনের পথও উন্মুক্ত হবে। অর্থনীতি করোনা সংকটে ১০ ভাগ সঙ্কুচিত হলেও নাগরিকের ভোগান্তি লাঘবে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

করোনাকালে মোনালিসা রেখে কী লাভ? মোনালিসা বেচে দেয়ার প্রস্তাব আগেও এসেছে। রহস্যময় হাসির এই ছবি আহামরি সুন্দর নয়- এমন একজন নারীর ছবি এত প্রহরা বসিয়ে বছরের পর বছর ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরের গ্যালারিতে ঝুলিয়ে রেখে কী লাভ? এটি কিন্তু ক্যানভাসে তেল রঙের বড় কোনো ছবি নয়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৫০৩ সালে পপলার কাঠের ওপর ৭৭ সেন্টিমিটার বাই ৫৩ সেন্টিমিটার মাপের ছবিটি আঁকেন। ১৫১৭ সালেও এর ওপর রঙের পোঁচ দেন। ১৯১১ সালে চুরি হয়ে যাওয়া মোনালিসা দুই বছর পর আবার ফিরে এসেছে। প্রতিবছর দর্শক বেড়েছে, মূল্যও বেড়েছে। করোনাকালে নগদ টাকার সংকটে ফ্রান্স যখন হাঁসফাঁস করছে, প্যারিসের ডিজিটাল কনসালটেন্ট স্তেফানি দিস্তিঙ্গুইন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন আরব রাজকুমারদের কারো কাছে ছবিটি অন্তত ৫০ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিলে এই সংকটের সময় হাতে টাকা আসে এবং সরকার টাকাটা শিল্প-সহায়তায় ব্যয় করতে পারে। ১৩ মে ২০২০ ইতালীয় সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, ফ্রান্সের এই পারিবারিক অলঙ্কারটি ভালো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়াটাই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায় উত্তম কাজ হতে পারে। ওদিকে পর্তুগালের মোট জাতীয় ঋণ ২১০ বিলিয়ন ইউরো। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কিছু চিত্রকর্ম- এর মধ্যে জোয়ান মিরোর আঁকা একটি ছবি ৩৬ মিলিয়ন ইউরোতে বেচে দেয়ার চিন্তা করছে। ওদিকে ফ্রান্সের মোট জাতীয় ঋণ ২ হাজার বিলিয়ন ইউরো। মোনালিসা বেচে সর্বোচ্চ ৫০ বিলিয়ন ইউরো পেলে তাতে মোট ঋণের দশমিক পাঁচ শতাংশের বেশি পরিশোধ করা যাবে না। এলিসি প্রাসাদের প্রেডিডেন্সিয়াল সেলারের মদ বিক্রি হচ্ছে এমনকি তাদের একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার কিনে নিচ্ছেন কাতারের একজন শেখ। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফ্রান্সের হ্যারিটেজ কোড অনুযায়ী মোনালিসা জনগণের সম্পদ। সরকারের বিক্রি করার কোনো অধিকার নেই। মোনালিসা বহু বিশ^ব্যাধি ও মহাযুদ্ধ পেরিয়ে এসেছি, অক্ষত অবস্থায় করোনাকালও পার করবে।

স্ট্রিট ভেন্ডার ইকোনমি উন্নয়নের প্রধান বলি স্ট্রিট ভেন্ডার- রাস্তার হকার। আমি কখনোই হকার উচ্ছেদের পক্ষে নই এবং হকারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দেয়ার পক্ষেও নই, আমি অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির গুরুত্ব কিছুটা অনুধাবন করতে পারি বলেই আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও এ ধরনের উচ্ছেদের বিরোধিতা করেছি। নির্দিষ্ট জায়গার প্রশ্নটি তখনই বিবেচনা করা যাবে যখন অর্থনীতি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, তার আগে নয়। তার আগে চাহিদা ও জোগানের সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী জোগানদার হিসেবে হকারই তার জায়গা ঠিক করে নেবে। চীন সরকার কিংবা চীনের স্থানীয় সরকারের অর্থনীতি জ্ঞান আমাদের সরকারের চেয়ে কম মনে করা হলে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি বলে ধরে নিতে হবে। সেখানে কর্তৃপক্ষই এখন হকারদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। সিচুয়ান প্রদেশের চেংডু বাজার করোনা সংক্রমণের পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন অর্থনীতি আগের অবস্থায় আনতে হকারদের পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে। কেবল স্ট্রিট ভেন্ডিং প্রদেশে ৯০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে থাকে। খাবার দাবার, খেলনা, ব্যাটারি, চার্জার থেকে শুরু করে ছোট আকারের ইলেকট্রনিক দ্রব্যও সেখানে মেলে। কেএফসি, পিৎজা হাটের মতো বনেদি খাবারের দোকানও বিশেষ ভ্যানে তাদের খাবার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি থাইল্যান্ড, কোরিয়া, তুরস্ক এবং চীনে মধ্যরাতে জমজমাট স্ট্রিট ভেন্ডিং চলতে দেখেছি- কখনো চোখে পড়েনি কোনো হকার পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মালামাল ফেলে কিংবা নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় রাস্তার হকার ও দোকানদারদের নিরাপত্তা দিতে ‘সেইফ সাইডওয়াক ভেন্ডিং অ্যাক্ট’ পাস করা হয়েছে। লসঅ্যাঞ্জেলেসে শহরের রাস্তায় ৫ লাখ হকার ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রতি বছর অর্থনীতিতে যোগ করে; ২০১৮-এর নভেম্বরে সিটি কাউন্সিলের সব সদস্য একমত হয়ে রাস্তায় বেচাকেনা বৈধতা আইন পাস করে। ইনফরমাল ইকোনমি মনিটরিং স্টাডির (আইইএমএস) প্রতিবেদনে দেখা যায় চুল কাটা থেকে গাড়ি মেরামত পর্যন্ত স্ট্রিট ভেন্ডিংয়ের আওতায় আসে। বাংলাদেশে স্ট্রিট ভেন্ডিংয়ের প্রধান অন্তরায় চাঁদাবাজি- তিন ধরনের চাঁদাবাজি এখানে সক্রিয় থাকে : ১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্য ২. রাজনৈতিক মাস্তান, যার অধিকাংশ সরকারি দলের ক্ষমতাবানদের আশীর্বাদপুষ্ট এবং ৩. রাজনৈতিক দলের নামের সঙ্গে নাম জড়িয়ে সৃষ্ট তথাকথিত হকার্স সমিতি। সরকারের সৎ উদ্দেশ্য অবশ্যই এসব দূরাচার দূরে সরিয়ে দিয়ে অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। হকার শুধু নিজের কর্মসংস্থানই নয়, কর্ম সৃষ্টিও করে- কুলি, নিরাপত্তা প্রহরী, গুদামরক্ষক এবং আরো কয়েক ডজন। মূল আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মিলন না ঘটলে অর্থনীতির যে চিত্র পাওয়া তা অসম্পূর্ণ ও বিকৃত। নগরে সৃষ্ট কর্মের ২৪ ভাগ পর্যন্ত হকার রয়েছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কোনো কোনো দেশে; ভারতে ১১ ভাগ, ভিয়েতনামে ১১ ভাগ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ ভাগ। স্ট্রিটন্যাট ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী ওকসানা অ্যাবুদ মনে করেন, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি কেমন করে কাজ করে অধিকাংশ সরকার তা বোঝেই না। তাদের এটা বোঝা জরুরি। তবে সরকারের লোকজন চাঁদাবাজিটা ভালোই বোঝে। ইস্তাম্বুলের রাস্তায় হকাররা ভালো বোঝেন পরিবর্তিত অবস্থায় রাতারাতি কীভাবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়। পরিবর্তন মেনে নিতে এবং খাপ খাওয়াতে বড় প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ সময় লাগে।

করোনাকালে সবচেয়ে বঞ্চিত ব্যবসায়ী এই স্ট্রিট ভেন্ডাররাই। তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই, রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতিপূরণ প্যাকেজও নেই; কিন্তু চাঁদাবাজি ঠিকই আছে। বাংলাদেশের রাস্তায় হকারদের প্রায় সবারই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দিনের খাবার নেই; অথচ দেশের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে তারাই তাদের বাবা-মা ও স্বজনদের কমবেশি টাকা পাঠিয়ে সেখানকার অর্থনীতিও উজ্জীবিত রাখে। যদি ঢাকার কথাই বলি বাস্তবতা এমন : ঢাকায় উচ্চবিত্তের যে আয় তা ব্যয় হয় ডালাস কিংবা টরেন্টোতে, মধ্যবিত্তের আয়ের একাংশ ঢাকায়, একাংশ বিদেশে খরচ হয়। কিন্তু নিম্নবিত্ত ঢাকায় যা আয় করে ব্যয় করে জলঢাকাতে অর্থাৎ প্রান্তবর্তী স্থানগুলোতে। এরা টাকা পাচার করে না, যেটুকু ব্যয় তার কিছুটা নিজের কোনো রকম টিকে থাকার জন্য এবং গ্রামে কিংবা শহুরে বস্তিতে বাস করা স্ত্রী ও সন্তানের জন্য বাকিটা পাঠায়। তাদের কোনো ইনসেন্টিভ নেই, ইনসেন্টিভ পায় মিথ্যা আর্থিক বিবরণী দাখিল করা মানি লন্ডারার। আশা করব, করোনাকালের সংকট থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করার দায়িত্ব যাদের, তারা রাস্তায় হকারদের বসিয়ে তাদের তিন ধরনের চাঁদাবাজের হাত থেকে রক্ষা করবেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App