×

জাতীয়

সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে লকডাউন কি আসলেই কার্যকরী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২০, ১২:২৫ পিএম

সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে লকডাউন কি আসলেই কার্যকরী?

লকডাউন

কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিস্তার কমানোর জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন মেয়াদে লকডাউন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে এবং এখনও কোথাও কোথাও চালু রয়েছে। সরকারের আরোপিত লকডাউন বা কোয়ারেন্টাইনের কারণে এই মানুষগুলো প্রথমবারের মতো তাদের নিত্যকার স্বাধীন জীবনযাত্রা, কাজকর্ম ও চলাচলে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৬৮ সালের হং কং ফ্লুতে মানুষ হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা পেলেও তা লকডাউন পর্যন্ত গড়ায়নি।

কোভিড-১৯ এর কারণে একইসঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতি, কোভিড ব্যতীত অন্য রোগের চিকিৎসা বিশেষ করে অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, প্রচলিত রোগ প্রতিরোধী কার্য্ক্রম, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু এখন অনেক দেশই তাদের আরোপিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে, তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয় রোধ ও এই রোগের কার্ভকে সমতল করার ক্ষেত্রে এই লকডাউন কীভাবে কতটা কার্যকরী এটাও ভাবার সময় এসেছে।

অনেক দেশ, যেমন চীন, জার্মানি এবং স্পেনে দেখা গিয়েছে যে লকডাউনের পর সংক্রমণের সংখ্যা কমেছে। চীনের এক গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সময়কাল লকডাউনের কারণে ২ থেকে বেড়ে ৪ দিন হয়ে যায়; যা থেকে বুঝা যায় যে লকডাউন সংক্রমণের গতি কমাতে পেরেছে। গবেষকদের মতে, ৫ সপ্তাহের লকডাউনের কারণে ইতালিতে দুই লাখ লোক হাসপাতালে কম ভর্তি হয়েছে এবং ভাইরাসের সংক্রমণের প্রায় ৪৫% কমেছে।

যুক্তরাজ্য যেখানে বর্তমানে সর্বোচ্চ কেসের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তারা ইউরোপের অন্যন্য দেশের তুলনায় দেরিতে লকডাউনে গিয়েছে। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে বলা যায়, যুক্তরাজ্য যদি আরও এক সপ্তাহ আগে লকডাউনে যেত তাহলেই তাদের মৃতের সংখ্যা অর্ধেক হতো। কারণ হলো, হঠাৎ সংক্রমণ এই ঊর্ধ্বগতি সামাল দেয়ার জন্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল সেটা তাদের ছিল না।

চীন, ইতালি, সাউথ কোরিয়া, ইরান, ফ্রান্স, এবং ইউ এসএতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লকডাউনসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা যেমন ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কারণে এই ৬টি দেশে প্রায় ৫৩০ মিলিয়ন সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।

কোভিড-১৯ এর অভিনব প্রকৃতির কারণে লকডাউনের মতো সংক্রমণ প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা গ্রহণের সময়কাল নির্ধারণ করাও একটি চ্যালেঞ্জ। কিছু কিছু দেশ বলেছে তাদের লকডাউন বাস্তবায়নের পূর্বে এর ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে বোঝাতে হয়েছে। আদর্শগত ভাবে, মহামারি শুরুর ২ সপ্তাহের মধ্য লকডাউন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন এবং এর ৬০% এক মাসের মধ্যে আরও ২০% পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে তুলে ফেলা যেতে পারে।

নিম্ন ও মধ্যম উপার্জনের বিভিন্ন দেশ; আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলোতে লকডাউনের কারণে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে, বিশেষ করে প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠী, যারা ঘণ্টা হিসেবে বা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে লকডাউনের কারণে তাদের আয় তাৎক্ষণিক ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন কর্মচারী যারা প্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত তারা দারিদ্রের সম্মুখীন হবার সম্ভাবনায় আছে। পক্ষান্তরে ধনী দেশগুলোতে সাময়িক ছুটি প্রদান, ঋণ সুদ স্থগিতকরণ ও অন্যন্য অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করবে। এর ব্যতিক্রমও দেখা গেছে, লকডাউন ছাড়াও করোনা কার্ভটি সমতল করার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।

ইউরোপে সুইডেন একমাত্র দেশ যারা তাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর মতো লকডাউন না দিয়ে বিতর্কিতভাবেই শুধুমাত্র সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থাপনা নিয়েছে। এই দেশের মতবাদ ছিল যেহেতু কোভিড-১৯ এর অধিকাংশ কেস উপসর্গবিহীন তাই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তাদের মতামত অনুসারে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করাই ছিল যৌক্তিক লক্ষ্য। কিন্তু বর্তমানে সুইডেনে ১০ মিলিয়ন জনসংখ্যায় মৃত্যু ৪৭৯৫। অন্যদিকে লক ডাউন দেয়া নরওয়ে ও ডেনমার্কে যথাক্রমে ৫ মিলিয়ন জনসংখ্যায় ২৩৯ এবং ৫.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যায় ৫৯৩ মৃত্যু ঘটেছে।

এখন পর্যন্ত হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের কার্যক্রম খুব বেশি কার্যকরী হয়নি, এই বিষয়ে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে কেবল মাত্র ৭.৩% জনগণের মধ্য কোভিড-১৯ এর অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের এই মহামারির গতি কমানোর জন্য আরও বেশি সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করাসহ টেস্টের পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। এমনকি হার্ড ইমিউনিটি যদি ব্যাপক সংক্রমণের মাধ্যমে অর্জিত হয়ও তারপর এই হার্ড ইমিউনিটি কত দিন থাকবে তার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা এখনই কেউ দিতে পারবে না।

সুইডেনের হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের এই যুক্তি যুক্তরাজ্যও লকডাউনে যাবার আগে বিবেচনা করেছিল, তারা ভেবেছিল লকডাউনের কারণে আংশিক জনগোষ্ঠী ইমিউনিটি অর্জন করবে যা এই বছরের শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণকে ত্বরান্বিত করবে।

একজন সুইডিশ চিকিৎসক, অধ্যাপক জোহান জিসেকেক, যিনি তার সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, লকডাউনের ফলে কেবল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ কমবে ও আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের হারকে স্থগিত করবে কিছু সময়ের জন্য যা শেষ পর্যন্ত হবেই।

অপরপক্ষে, এখন যে দেশগুলো কঠোরভাবে লকডাউন করে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা কেবল ভবিষ্যতে অধিক পরিমাণে মৃতের সংখ্যা দেখার জন্যই এটা করছে। তবে যদি একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন বিস্তৃত জনগোষ্ঠীকে দেয়া যায় এবং লকডাউনের ফলে সংক্রমের হার কমিয়ে এনে যদি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় তাহলেই সম্ভাব্য মৃত্যু সংখ্যা কমানো যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এর মতো লকডাউনের কার্যকারিতাও অনিশ্চিত। এটি অনেকাংশে বিশ্বের জনগোষ্ঠীর আচরণের ওপর নির্ভরশীল এবং অন্য যেকোনো ওষুধের মতো লকডাউনের কার্যকারিতা নির্ভর করবে এর আরোপণ করার সময়, পরিমাণ ও সময়কালের ওপর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App