×

জাতীয়

টেস্ট ও রিপোর্টের চক্কর!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২০, ১০:১১ এএম

টেস্ট ও রিপোর্টের চক্কর!

প্রতীকী ছবি

টেস্ট ও রিপোর্টের চক্কর!
রাজধানীর দয়াগঞ্জের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোস্তফা জামান (৪৭)। তিন-চার দিন ধরে করোনা সংক্রমণের বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে তার মধ্যে। প্রথম দিন থেকেই নমুনা পরীক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গিয়েছেন মুগদা হাসপাতালে। মানুষের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আরো অসুস্থ হয়ে ফিরেছেন বাসায়। এরপর ভেবেছিলেন অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে ভোগান্তি অনেকটাই কম হবে, পাবেন নমুনা দেয়ার সিরিয়াল। কিন্তু টানা তিন দিন সকালে শত চেষ্টায়ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ওয়েবসাইটে (www.bsmmu.edu.bd) রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি মোস্তফা জামান। শামসুল আলমের (৫৬) সমস্যাটা ভিন্ন। অনেক ভোগান্তি সহ্য করে অবশেষে নমুনা দিতে পেরেছেন তিনি। অথচ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও মিলছে না পরীক্ষার ফলাফল। এর মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে বুকে ব্যথাও অনুভব করছেন এই হার্টের রোগী। কিন্তু হাতে রিপোর্ট না আসায় দেখাতে পারছেন না চিকিৎসক। হাঁটুর ব্যথাসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত মানিকনগরের বাসিন্দা মিনারা বেগম (৬৮)। বড় ছেলে মামুন আবেদীনের সঙ্গেই থাকেন। ছেলে করোনায় আক্রান্ত। বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেক চেষ্টার পর স্ত্রী ও দুই সন্তানের করোনা টেস্ট করিয়েছেন। তারা নেগেটিভ। কিন্তু মিনারা বেগমের পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ হাঁটুর সমস্যার কারণে তিনি দাঁড়াতেই পারেন না। মামুন জানান, হটলাইনে যোগাযোগ করেও বাসা থেকে তার মার নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। বেসরকারি যে হাসপাতালগুলো বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তাদের সিরিয়ালও পাওয়া যাচ্ছে না দুই সপ্তাহের আগে। এদিকে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর ধাঁধায় পড়ে গেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিপ্লব কিশোর সাহা। নমুনা দেয়ার চার দিন পরই রিপোর্ট পেয়েছেন তিনি। তার মোবাইল ফোনে একই দিনে এসেছে দুটি এসএমএস। ১৯ জুন বিকালে আসে প্রথম এসএমএস। তাতে জানানো হয় তিনি করোনা নেগেটিভ। এতে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন বিপ্লব। কিন্তু সন্ধ্যায় আবার তার ফোনে এলো আরেকটি এসএমএস। তাতে জানানোহলো তিনি করোনা ‘পজেটিভ’। সবমিলিয়ে তার অবস্থা অনেকটা শাঁখের করাতের মতোই। এই করোনা মহামারিকালে মোস্তফা জামান, শামসুল আলম কিংবা মিনারা বেগমের মতো অনেককেই পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ভোগান্তি আরো বেশি। দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও অনেকে পরীক্ষাই করাতে পারছেন না। অন্যদিকে বিপ্লব কিশোর সাহার মতো ঘটনা খুব বেশি না হলেও এমন জটিল পরিস্থিতিতেও পড়তে হচ্ছে কাউকে কাউকে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে প্রায় সময়ই জানানো হয়, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে নতুন করে পরীক্ষাগার যুক্ত হওয়ার তথ্য। কিন্তু এরপরও নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে মানুষকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। দেরি হচ্ছে পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেও। অনেক ক্ষেত্রে জানানো হচ্ছে ভুল রিপোর্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ৬২টি ল্যাবরেটরিতে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হচ্ছে। তারপরও সংকট কাটেনি। ল্যাবগুলোতে পরীক্ষার জন্য নমুনা স্ত‚প হয়ে থাকছে। পরীক্ষার চাপ বাড়ায় এক ল্যাবের নমুনা পাঠাতে হচ্ছে আরেক ল্যাবে। করোনা পরীক্ষার পরিধি না বাড়িয়ে শুধু নমুনা সংগ্রহ বাড়িয়ে লাভ নেই। এতে মানুষের ভোগান্তি কমবে না বরং বাড়বে। তারা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে ফেলা। তাদের আইসোলেশনে রাখা। আর তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা। কিন্তু রোগী চিহ্নিতের কাজটিই যদি সঠিক সময়ে না হয় তাহলে সংক্রমণ কমার বদলে বাড়বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, অদক্ষ হাতে নমুনা সংগ্রহ করায় দেশের বিভিন্ন ল্যাবে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল আসছে। এমনও ল্যাব আছে, যাদের অনেক নমুনাই পুনরায় পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে লক্ষাধিক টাকার কিট নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে অনেক কর্মঘণ্টাও। তিনি আরো জানান, রিপোর্টের ভুল তথ্যের অনেক অভিযোগ আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। অনেকেই ডকুমেন্টসহ অভিযোগ করছেন। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না। পরীক্ষার পরিধি না বাড়িয়ে শুধু নমুনা বাড়িয়ে লাভ নেই বলে মনে করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহ যেমন বাড়ানো উচিত, তেমনি যারা নমুনা পরীক্ষার জন্য দিয়েছেন তাদের কাছে সময়মতো রিপোর্টটা দেয়াও অত্যন্ত জরুরি। এই দুটি ক্ষেত্রেই সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম থেকেই টেস্টের বিষয়ে জোর দিয়ে আসছে। পরীক্ষার সুবিধা বাড়িয়ে শনাক্ত সংখ্যা বাড়াতে হবে। শনাক্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদেরও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। তবে নমুনা সংগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার সেগুলোও সঙ্গতিপূর্ণভাবে বাড়ানো প্রয়োজন। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন জানান, নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যাবে পরীক্ষা করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এর জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই থাকতে হবে দক্ষ জনবল। থাকতে হবে দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টও। তাদের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করালে ফল পাওয়া যাবে না। এদিকে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে নতুন কৌশল নিতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরই অংশ হিসেবে আরটিপিসিআর নির্ভরতা কমাতে এন্টিজেন টেস্ট পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, তারা প্রত্যেক জেলায় পিসিআর ল্যাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। সেইসঙ্গে বিকল্প হিসাবে এন্টিজেন পরীক্ষা শুরুর পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই এই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করা হবে বলেও জানান তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল আসার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় জড়িত। যেমন নমুনাটি কখন সংগ্রহ করা হয়েছে তা খুবই গুরুতপূর্ণ। ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দুই দিন এবং সপ্তম দিনের পর নমুনা নিলে ফলাফল অনেক সময় ভুল আসতে পারে। এছাড়া কোথা থেকে অর্থাৎ ফুসফুসের পানি, লালা, কফ নাকি নাক থেকে নমুনা নেয়া হয়েছে তার উপরও ফলাফল নির্ভর করে। ফুসফুসের পানি থেকে নমুনা নেয়া হলে ৯৪ শতাংশ, মুখের লালা থেকে নেয়া হলে ৪২ শতাংশ, কফ থেকে নেয়া হলে ৬২ শতাংশ এবং নাকের নমুনা নেয়া হলে ৭২ শতাংশ সঠিক ফলাফল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহের পর তা সঠিক তাপমাত্রায় রাখা হয়েছিল কিনা, পরীক্ষার ফলাফল সঠিকভাবে নিবন্ধন করা হয়েছে কিনা এসব বিষয়ও সঠিক ফলাফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App