×

জাতীয়

ইউরোপ-আফ্রিকায় নতুন শ্রমবাজারের সম্ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২০, ০৯:৩৪ এএম

ইউরোপ-আফ্রিকায় নতুন শ্রমবাজারের সম্ভাবনা
ইউরোপ-আফ্রিকায় নতুন শ্রমবাজারের সম্ভাবনা

প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সংকুচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। ইউরোপ আমেরিকাসহ ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক রয়েছে এমন সব দেশের শ্রমবাজারে চলছে অশনি সংকেত। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে দলে দলে ফেরত আসছে শ্রমিক। নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ স্পেশাল ফ্লাইটে করে শত শত বাংলাদেশি কর্মীকে ফেরত পাঠাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব দেশে কাজ করা বাংলাদেশিসহ বিদেশি শ্রমিকদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। মহামারির পর এই সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বড় বিপর্যয়ের মুখে ইউরোপ ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন শ্রমবাজার হিসেবে পূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকায় নতুন সম্ভাবনা দেখছে সরকার। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, মধ্যপ্রাচের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এটা অবশ্যই শঙ্কার। তবে আমরা নতুন বাজারের সন্ধানে আছিব। সুখবর হলো, আফ্রিকাতে আমাদের শ্রমিকদের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এই মহামারির পর বিরাট এক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের লোকজন কৃষিতে খুব ভালো। সারা আফ্রিকায় উর্বর জমি পড়ে আছে। তাদের জমি ভালো, জলবায়ুও ভালো। ড. মোমেন বলেন, সুদানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আমরা যদি লাখ লাখ শ্রমিক পাঠাতে পারি তাহলে তারা সেখানে প্রচুর ফসল ফলাতে পারবেন। এতে আমাদের উপকার হবে, সেসব দেশেরও উপকার হবে। আবার বিশ্বে খাদ্য ঘাটতিও কমবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে ৩০ হাজার কর্মী ফিরবে বলে আমরা একটা তালিকা পেয়েছিলাম। এর বাইরে কত ফিরবে সে হিসাব এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কয়েক লাখ কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের মতে, আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে লাখ লাখ বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের যে সুযোগ রয়েছে, সেজন্য সরকারের বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেছেন, কম্বোডিয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের নতুন গন্তব্য। ভিয়েতনাম ও লাওসসহ কয়েকটি দেশও কর্মী নিবে। সোমালিয়া ও সুদান হতে পারে নতুন শ্রমবাজার।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ প্রসঙ্গে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং অন্যদের সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবে। কীভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় এবং নতুন সুযোগ কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে আলোচনা হবে। পিপিই বা অন্য ধরনের সামগ্রী আমাদের তৈরি পোশাক খাত বানাতে সক্ষম এবং এগুলোর চাহিদা এখন অনেক বেশি। ইউরোপে নার্সের চাহিদা আছে, দেশের ঘাটতি পূরণ করে যদি বাকি নার্সদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ভাষা শিক্ষা দেয়া যায় তবে আগামীতে প্রচুর সুযোগ আছে। দেশে নার্সিং শিক্ষার সার্টিফিকেট যাতে বিদেশে স্বীকৃতি পায় সেজন্য কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রলণালয়। এছাড়া ওয়েল্ডার্স বা প্লাম্বারের মতো পেশাজীবীর বিদেশে চাহিদা আছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ নিতে চায়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও রপ্তানি ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটলে বিদেশে নানা ধরনের শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হবে। সেইদিক বিবেচনায় রেখে সরকার বিদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপ হতে পারে বাংলাদেশিদের নতুন শ্রমবাজার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের অগ্রাধিকার। তবে এটি ইউরোপের সক্ষমতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইউরোপের একটি কোম্পানি বাংলাদেশে ৩৮টি কোম্পানিতে অর্ডার দিয়েছিল কিন্তু সেটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। এখন ওই কোম্পানিকে কিছু বলা অবান্তর, কারণ তার অর্ডারের আর কোনো মূল্য নেই। যেসব জায়গায় সম্ভব, সেই জায়গায় আমাদের দেনদরবার করতে হবে। যে কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে তার তো কিছুই নেই। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত রয়েছেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। তবে বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাসে বলছে, এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে ২২ শতাংশ রেমিট্যান্স কমবে। ইতোমধ্যে গত মার্চের তুলনায় এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমেছে ২৪ কোটি ডলার। অবশ্য মে মাসে তা বেড়েছে।

ত্র আরো জানায়, ২০১৮ সাল থেকে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া, সুদান, উগান্ডা এবং জাম্বিয়া বাংলাদেশকে ‘বিনিয়োগ ও কর্মংস্থান’ সৃষ্টির প্রস্তাব দিয়ে আসছে। সেসব প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা দেশগুলোতে সহজ শর্তে কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্য, কৃষিজ খাদ্যশিল্প এবং তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। করোনা ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপ মহাদেশ। শুক্রবার সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বে মোট ৮৫ লাখ ১ হাজার ৪৪৪ জন করোনা রোগীর মধ্যে ৪ লাখ ৫৪ হাজার ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দেড় লাখই ইউরোপের। এক লাখেরও বেশি আক্রান্ত হয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে ৬টি দেশও ওই মহাদেশে। সংক্রমণ রোধে গত মার্চ থেকে কারফিউ ও লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার। আন্তঃইউরোপ ছাড়া সব ধরনের আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগ স্থগিত করে প্রায় সবকটি দেশ। এর ফলে নিজস্ব অর্থনীতির পাশাপাশি তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রাখা বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একক মহাদেশ হিসেবে ইউরোপই হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। এই মহাদেশে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ এক হাজার কোটি ইউরোরও বেশি। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকায় বাংলাদেশের পণ্যের বিশেষ করে তৈরি পোশাকের চাহিদা আছে ইউরোপের বাজারে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এর ওপরও বড় প্রভাব পড়েছে। তবে সেখানকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে কীভাবে চলমান চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তরিত করা যায় তা নিয়ে ইউরোপে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। নতুন সুযোগ অন্বেষণ, তৈরি পোশাকশিল্পের অর্ডার রক্ষা ও অভিবাসীদের সুরক্ষা দেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

উল্লেখ্য, ইউরোপে অবস্থিত বেশিরভাগ বাংলাদেশি সেবা খাতে কর্মরত। এদের মধ্যে গ্রিসে অল্প সংখ্যক কৃষি শ্রমিকও আছেন। ভালো নেই পর্তুগালে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনসহ বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে হাজারও ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র লিসবনের ডাউনটাউন এলাকায় গড়ে উঠেছে ২ হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; যেখানে প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত ছিলেন। তারা এখন বেকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App