×

মুক্তচিন্তা

হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে করুণ মৃত্যু

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ০৯:২৭ পিএম

আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ কি এসব নৈরাজ্য, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসার মান ইত্যাদি কোনো কিছুরই দায় বহন করবে না, চেষ্টা করবে না সার্বিক উন্নত ব্যবস্থাপনার? আর করোনার কথা তো না বলাই ভালো। সে ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার কথা বহু আলোচিত। শুরুতে যে দৃশ্যচিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে তার সঙ্গে এদের কোনো মিল মেলে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে?

‘হাসপাতাল’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই যে দৃশ্যচিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে তা হলো সাদা অ্যাপ্রোন পরা চিকিৎসক ও সেবিকা, ধবধবে সাদা কাপড়ে মোড়া শয্যা, যা প্রথাগত ভাষায় ‘বেড’ অর্থাৎ রোগীর শয্যা এবং সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক কর্মব্যস্ততা। লক্ষ্য একটাই, রোগ ও রোগীর চিকিৎসা। এবং তা কী সরকারি, কী বেসরকারি পর্যায়ে। সঙ্গত কারণে ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘চিকিৎসা’- এ শব্দ দুটির সঙ্গে আরো একটি শব্দ যুক্ত হয়ে আছে দীর্ঘকাল থেকে, কারো মতে প্রাচীনকাল থেকে, আর তা হলো ‘সেবা’। তাই অন্যান্য পেশার তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী এ শব্দ দুটি ‘স্বাস্থ্যসেবা’ এবং ‘চিকিৎসাসেবা’ হিসেবে এই আধুনিক যুগেও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে চলেছে। কারণ একটাই। এ পেশা মানুষের জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। রোগাক্রান্ত মানুষকে বাঁচানো মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের মাধ্যমে, এই মহৎ লক্ষ্যের কারণে এ পেশার গুরুত্ব। এবং চিকিৎসক-সেবিকার অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে, কখনো নিজ জীবনের প্রতি ঝুঁকি নিয়ে। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মহামারিও এই শিক্ষাই তুলে ধরেছে, বিশেষ করে উন্নত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ উদ্দেশ্য পূরণে বহুকাল থেকে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনের তাগিদে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক যুগে এর উন্নয়নই নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাসেবা সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতেরও প্রতিষ্ঠা- এর বিভিন্ন বিভাগ, যেমন প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় তেমনি প্রতিকার, তথা প্রত্যক্ষভাবে রোগীর চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থায়। আগেই বলেছি, শেষোক্তিটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হাসপাতাল।

দুই. আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পণ্য ও মুনাফা তথা সেই সঙ্গে বাণিজ্য সমাজ ও সভ্যতার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বভাবতই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিশেষভাবে চিকিৎসাসেবা ও পণ্যে পরিণত- ‘দাতব্য চিকিৎসা’ শব্দ দুটি বিস্মৃত অতীত কথা, এখন অভিধানের অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসাসেবা এখন পুরোপুরি বাণিজ্যে পরিণত, অবশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতাল সীমানার বাইরে। এই বাণিজ্যিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার টানে বেসরকারি খাতে বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে বহু হাসপাতাল ও ক্লিনিক যেখানে চিকিৎসাসেবা দুর্মূল্য, সাধারণ স্তরের মানুষের পক্ষে সে সেবা ক্রয় করা বেশ কঠিন। জনবান্ধব চিকিৎসাসেবা দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহানগর রাজধানী ঢাকা বিশেষভাবে এ অবস্থার শিকার। স্বাস্থ্যবিধির নিয়মমাফিক সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থাৎ বেসরকারি বৃত্তের এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক ব্যক্তিগত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হলেও জনসেবার নীতিনিরিখে এগুলোর সেবামূলক মান, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে যাতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নীতিবহির্ভূত মুনাফাবাজি সেখানে প্রাধান্য না পায়। ভূখণ্ড-আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই রোগাক্রান্ত লোকের সংখ্যাও বেশি। বাংলাদেশে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে একটি ধনিক শ্রেণির বিকাশও ঘটেছে যারা যে কোনো মূল্যের চিকিৎসাসেবা কিনতে সক্ষম। আর সেসব কারণেই কিনা জানি না, রাজধানী ঢাকা চিকিৎসা-বাণিজ্যের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তাই শুধু যে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও রমরমা ব্যবসা, তেমনি সেই টানে বিদেশ থেকেও স্বনামখ্যাত ব্র্যান্ডের চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানের মহানগরী ঢাকায় আগমন এবং দুর্লভ মূল্যের হাসপাতাল স্থাপন। সেই ব্র্যান্ড নামের আকর্ষণে উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং বিত্তবানদের সেখানে ভিড় দুর্মূল্য সুচিকিৎসা নেয়ার জন্য। এদের ওপরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের।

তিন. বেশ চলছিল চিকিৎসা খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের তৎপরতা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে। গোল বাধাল মহাপরাক্রান্ত করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ। ভীত, শঙ্কিত চিকিৎসক সমাজ ও সেবিকা দল। কারণ এরাই করোনা ভাইরাসের সহজলভ্য শিকার। বাস্তবে ঘটেছে তাই। এ যাবৎ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে যে চিকিৎসক ও সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তুলনামূলক বিচারে সর্বাধিক হারে আক্রান্ত। এ কারণেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, কী চিকিৎসক, কী বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগাক্রান্তকে চিকিৎসাসেবা দেয়ায় অস্বীকার করতে পারে না, পারে না চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি থেকে এ কালীন নিয়মনীতি ও আদর্শের বিচারে। সুসময়ে অজস্র-অর্থ উপার্জন করব রোগীর চিকিৎসায়, কিন্তু দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে নেব- এটা নীতিবিরুদ্ধ। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের বেসরকারি চিকিৎসা খাত অর্থাৎ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো এই নীতিবিরুদ্ধ পথ ধরেই চলেছে। এবং তা করোনা সংক্রমণের ভয়ে। প্রথম থেকেই এ পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে একের পর এক খবর প্রকাশিত হয়েছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালের দরজা থেকে ফিরে শেষ পর্যন্ত করুণ মৃত্যু গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার অভাবে।

এরা কেউ করোনায় আক্রান্ত রোগী নয়, বিভিন্ন ধরনের গুরুতর জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী। হঠাৎ অবস্থার অবনতি ঘটায় হাসপাতালের শরণ নেয়া। কিন্তু কোনো যুক্তি তথ্য বিচার না করে, করোনা রোগী সন্দেহে বা অন্য কোনো কারণে হাসপাতাল গেট থেকে বিদায় দেয়া কোন চিকিৎসাশাস্ত্রের নীতিসম্মত কাজ? যে চাকমা যুবকটি হাসপাতালের দরজা থেকে দরজা থেকে বিনা চিকিৎসায় ফিরে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলো, যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে একইভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কবলে, নাম গৌতম আইচ। তার কন্যা একজন চিকিৎসক। তাতেও কোনো সুবিধা নেই। এ দায় কার? এমন অনেক ক’টা অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঘটনার খবর পড়ে ভেবেছি, আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ, সর্বোচ্চ স্তর থেকে অধিদপ্তর- তাদের চোখে কি পড়ছেন এই দুঃসংবাদগুলোর কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এ জাতীয় অনিয়ম, আদর্শহীনতা ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তো একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তারও কি মনে হচ্ছে না যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এ জাতীয় আচরণ নীতিবিরুদ্ধ, চিকিৎসাশাস্ত্রীয় এথিকস তা অনুমোদন করে না। কোনো হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার পৃথক ব্যবস্থা না থাকতে পারে, কিন্তু অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা তো তারা স্বাভাবিক সময়ে করে থাকে, এখন করবে না কেন? প্রত্যেকটি জীবন মূল্যবান, যা একবার গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীকে ‘আইসোলেশনে’ রেখে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে চিকিৎসা চলতে পারে, এটা সাধারণ ব্যবস্থা। তা না করে নিছক করোনা সন্দেহবশত একজন মরণাপন্ন বা গুরুতর অবস্থার রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি না করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কি সঠিক কাজ? এভাবে যে মৃত্যুগুলো ঘটল, তার দায় কার, কে নেবে এর দায়িত্ব। সাধারণ বিবেচনায় প্রথমত ও প্রধানত এ দায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর। পরোক্ষে এর দায় কি স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর বর্তায় না, যাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব বেসরকারি হাসপাতাল? নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও মনে হয়, এদের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হয়তো তাই বিএমএ মহাসচিব স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কঠিন দুটি নিবন্ধ লিখেছেন দুটি পত্রিকায়।

এতসব সত্ত্বেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ রোগের (গুরুতর হলেও) চিকিৎসার দায়িত্ব সঠিকভাবে নিচ্ছে না। তাই দৈনিকগুলোতেও এদের বিরুদ্ধে লেখালেখি বন্ধ হচ্ছে না। এ অবস্থা শুধু ঢাকায়ই নয়, দেশের সর্বত্র বেসরকারি হাসপাতালে। হাতের কাছে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে’। দীর্ঘ প্রতিবেদনটিতে না গিয়ে মর্মার্থ হিসেবে বলা চলে (এদের ভাষায়) : ‘গুরুতর অসুস্থ অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছে, ভর্তি হতে পারছে না’। এসব ঢাকার বাইরে শহরগুলোতেও। সেখানে আবার চিকিৎসাগত মানেরও অভাব। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ কি এসব নৈরাজ্য, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসার মান ইত্যাদি কোনো কিছুরই দায় বহন করবে না, চেষ্টা করবে না সার্বিক উন্নত ব্যবস্থাপনার? আর করোনার কথা তো না বলাই ভালো। সে ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার কথা বহু আলোচিত। শুরুতে যে দৃশ্যচিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে তার সঙ্গে এদের কোনো মিল মেলে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে?

আহমদ রফিক : ভাষাসংগ্রামী ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App