×

মুক্তচিন্তা

বজ্রাঘাতে বিস্তর প্রাণহানি

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ০৯:০৫ পিএম

দুর্যোগ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে আধুনিক দুর্যোগ খরা, লবণাক্ততা ও অধুনা আরেকটি ভয়ঙ্কর দুর্যোগ হিসেবে রূপ ধারণ করেছে বজ্রপাত, যার বিস্তৃতি ও বীভৎসতা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে বজ্রপাতের রেড জোন বা ডেড জোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এ বছর এপ্রিল থেকেই প্রকৃতি তার নিষ্ঠুর রূপ দেখানো শুরু করেছে এবং এবারের এপ্রিলের রুদ্ররূপ বিগত কয়েক দশকের এপ্রিলের চেয়ে নিষ্ঠুরতর হয়েছে। তাপমাত্রার রেকর্ড অনুযায়ী বিগত ১৩৭ বছরের সব এপ্রিলের তুলনায় দ্বিতীয় উষ্ণতম ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। আবার ২০২০-এর এপ্রিলের তুলনায় ২০১৯-এর এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এনসিইপি গ্লোবাল টেম্পারেচার ফোরকাস্ট মডেল অনুযায়ী এ বছর তাপমাত্রার আকস্মিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হবে অচিরেই। বায়ুদূষণসহ অন্যান্য দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত তাপমাত্রার আকস্মিক ক্রমোন্নয়ন বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রকাণ্ড বজ্রমেঘ তৈরিতে বিষদ ভূমিকা রাখবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটিও অনুমেয় যে এবার বজ্রপাতের মৌসুম প্রলম্বিত হবে এবং সেইসঙ্গে আরো বজ্রমৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়বে। অতিমাত্রায় অপ্রত্যাশিত প্রায় ৩৫০টি বজ্রমৃত্যুতে ২০১৬ সালে বজ্রপাত জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে আটটি লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করা হয়েছিল বলে আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলাম। রাডারগুলো বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই পূর্বাভাস দেবে এবং আমাদের কৃষক, জেলে ও মাঠপর্যায়ে কর্মরত নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রাণসংহার রোধ করা সম্ভব হবে বলেই আমাদের ধারণা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। নিজেদের প্রবোধ দেয়ার জন্য এ ধরনের উচ্চমাত্রার স্পর্শকাতর ও উচ্চ কারিগরি প্রযুক্তির প্রয়োগ আপাতত কারিগরি ত্রুটি, পরিচালন দক্ষতার অভাব, তথ্য সংগ্রহে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবলের অপ্রতুলতা, নেটওয়ার্ক সমস্যা, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা ও পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার অভাব ইত্যাদির ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো হবে হয়তো! কিন্তু এতে প্রাণহানি থেমে থাকবে না, বৈরী প্রকৃতি করোনা ভাইরাসকেও আমলে নিয়ে তাদের তাণ্ডব থামিয়ে রাখবে না। বৈশাখজুড়েই চলেছে বজ্রমেঘের ঘনঘটা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর-পূর্বমুখী প্রচণ্ড বেগের বায়ুপ্রবাহ সহযোগে বজ্রপাত ও বজ্রঝড় ইদানীংকালে আমরা দেখছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের বজ্রমেঘের স্থায়িত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের বেশি না হলেও স্বল্প সময়ের এই তাণ্ডবলীলা ও ধ্বংসযজ্ঞ মানবজীবনে দীর্ঘতর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে জীবনহানির মাধ্যমে, যার মূল শিকার হচ্ছে খেটে খাওয়া কৃষক, জেলে ও মুটে-মজুররা। চলছে হাওরে বোরো ধান কাটার মৌসুম। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং কিছুদিন ধরে চলতে থাকা বন্যার ভয়ও কেটে গেছে। করোনা মহামারির মধ্যে সময়মতো ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল তা প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত দিকনির্দেশনায় এবং অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উতরানো সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে। যদিও সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ হাজার ৪০ টাকা মণ দরে ধান সংগ্রহের কথা ছিল কিন্তু কৃষকের কাছে দাম মিলছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। ক্ষেত্র এবং অঞ্চলবিশেষে অদ্যাবধি ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ বোরো ধান কাটা সম্ভব হয়েছে কিন্তু ধান কাটার সময় বজ্রাঘাতে কৃষকের জীবনহানির প্রচণ্ড ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখা এই শ্রেণির মানুষগুলোকে বাঁচাতে এখনই যথাযথ উদ্যোগ আবশ্যক। এরই ফলে ধান কাটার সময় মৃত্যু হলে মৃত কৃষকের পরিবার ১ লাখ টাকা পাবে বলে কৃষিমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। গত বছর এই প্রণোদনাটি বর্তমানের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছিল। সেলফোনের টাওয়ারে লাইটনিং এরেস্টার লাগানোর মতো সম্ভাব্য একটি কারিগরি সমাধানের কথা আমরা পত্রিকা মারফত জেনেছি। সেলফোনের টাওয়ারে লাইটনিং এরেস্টার লাগিয়ে ঝুঁকি কমানো গেলেও তা সেলফোন কোম্পানিগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে আর্থিক ও যান্ত্রিক ক্ষতির কারণ হবে বজ্রপাতের অতি উচ্চ তাপমাত্রা এবং ভোল্টেজের কারণে। তাছাড়া বিস্তীর্ণ হাওর বা বাঁওড়ের অনেক স্থানেই সেলফোন টাওয়ার নেই। কাজেই হাওর, বাঁওড় এলাকার ফসলের মাঠে লাইটনিং এরেস্টার ব্যবহার করে বজ্রমৃত্যুহার কমানো ততটা বাস্তবিক হবে না হয়তোবা। প্রতি বছরই বোরো ধান কাটার মৌসুমে বিস্তর প্রাণহানি ঠেকাতে হাওর-বাঁওড়ে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অস্থায়ী শেল্টার জোন বা পাকা ঘর নির্মাণ স্বল্পমেয়াদি বজ্রপাত ব্যবস্থাপনার আওতায় নেয়া হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। ড. এম এ ফারুখ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App