×

জাতীয়

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন কে এই মিঠু?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২০, ০৯:৫৫ এএম

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন কে এই মিঠু?

মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু

কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারের মধ্যে নেই নাম বিদেশে অর্থপাচারকারী হিসেবে নাম এসেছিল পানামা পেপারসে অনেক মন্ত্রী-সচিব তার ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত বিদেশে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করেন স্বাস্থ্য খাতের সব ঠিকাদারি

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য কাউকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হলে প্রথমেই আসবে এ সেক্টরের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারের মধ্যে এই গডফাদারের নাম নেই। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে অন্য যেসব দুর্নীতিবাজ রয়েছে তাদের মিঠুর তুলনায় ‘শিশু ও চুনোপুঁটি’ হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য গত বছরের ১২ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাঠানো সুপারিশের ভিত্তিতে এ তালিকা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুদকের পাঠানো তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে।

টাকার পাহাড় গড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি-স্টেনোগ্রাফার আবজাল হোসেনের বিষয়টি গত বছর গণমাধ্যমে উঠে আসার পর ব্যাপক অনুসন্ধানে নামে দুদক। এরপরই স্বাস্থ্য খাতের ‘সর্বেসর্বা’ হিসেবে মিঠুর নাম বেরিয়ে আসে। যদিও অজানা কারণে দুদকের কালো তালিকাভুক্তিতে স্বাস্থ্য খাতের এই ডনের নাম ছিল না। জানা যায়, দুদকে এর আগেও কয়েকবার তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। বারবারই অজ্ঞাত কারণে সে পার পেয়ে যায়। কথিত আছে, স্বাস্থ্য খাতের মতো দুদকেও রয়েছে তার শক্তিশালী একটি চক্র। সরকারের অন্য সেক্টর থেকে প্রেষণে আসা দুদকের এক ক্ষমতাধর পরিচালকের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা।

দুদকের এই চক্রই মূলত তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন সাবমিশন’ মামলা করেছিল দুদক। কিন্তু দুদকের ভেতরের ওই চক্রের কারণেই মামলাটি বেশি দূর এগোয়নি। এ বিষয়ে আবজাল হোসেনের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত আবজাল হোসেন হচ্ছে মিঠুর শিষ্য। আবজালের অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিঠুর নাম বেরিয়ে আসলেও গত ৫ বছর এ খাতের সঙ্গে মিঠুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। এছাড়া ৫ বছর আগে মিঠুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও তাকে ধরার মতো বর্তমানে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া মুশকিল। এ জন্যই হয়তো দুদক তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেনি।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমাদের টিম দুর্নীতির উৎস ও প্রতিকার নিয়ে কাজ করেছে। তারা অনুসন্ধানে যা পেয়েছে প্রতিবেদনে তাই উল্লেখ করেছে। তারপরও বিষয়গুলো আমাদের মহাপরিচালকরা দেখছেন। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হলে তো তার সংশ্লিষ্টতা ও তাকে ধরার মতো পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ থাকতে হবে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনাটা হাস্যকর হবে না? ইকবাল মাহমুদ বলেন, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা করলে আদালতেও তো সুফল পাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্য খাতের সর্বক্ষেত্রে মিঠুর সিন্ডিকেটের বিষয়টি দুদক চেয়ারম্যানের নজরে আনলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি তো আমাদের দেখার বিষয় না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিব বরাবর লেখা এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মিঠুর নাম উল্লেখ করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার মিঠু কীভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই তথ্যও চিঠিতে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক। তারপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন মিঠুকে কালো তালিকাভুক্ত করেনি সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

কে এই মিঠু: অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো স্বাস্থ্য খাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্য খাতে মিঠু মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচরার মহিপুর ইউনিয়নে। মিঠু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকেন। বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্য খাত। বিদেশেও রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। ২০১৬ সালে বিশ^ তোলপাড় করা পানামা পেপারসে বিদেশে অর্থপাচারকারী যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম এসেছিল, এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুও তাদের একজন।

দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব খাটান। কখনো তা অর্থের মাধ্যমে, আবার কখনো হুমকি-ধামকির মাধ্যমে। মিঠুর সিন্ডিকেটের মর্জিমতো কাজ না করে উপায় নেই- বলছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি হাসপাতালের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। কারণ এই সিন্ডিকেটের লুটপাটসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের অনেকের যোগসাজশ রয়েছে। টেন্ডার কারসাজিতে পটু এই সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে সিনিয়র পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসক, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও বাইরের কিছু দালালকে ব্যবহার করা হয়। এরা সরকারি যে হাসপাতাল বা যে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সেই হাসপাতালের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে নেয়। টেন্ডার যেভাবেই আহ্বান করা হোক না কেন, যে বা যারাই টেন্ডারে অংশ নিক না কেন- কাজ তাদেরই দিতে হবে।

ওই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকলেও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চাহিদা তৈরি করা হয়। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তারাই এনে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এরপরই শুরু হয় টেন্ডার কারসাজি। টেন্ডার ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয় টেন্ডার সিডিউল তৈরি করার সময়ই। সিন্ডিকেটের বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ যাতে টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে সেভাবেই ‘স্পেসিফিকেশন’ তৈরি করা হয়। সিন্ডিকেটের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কেউ টেন্ডারে অংশ নিলেও সেগুলোকে নানা অজুহাতে ‘নন-রেসপন্সিভ’ করা হয়। এভাবেই কমমূল্যের যন্ত্রপাতি বেশি মূল্যে বা অস্বাভাবিক মূল্যে সরবরাহের কার্যাদেশ আদায় করে নেয় সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারপরও এরা ক্ষান্ত হয় না। এক দেশের তৈরিকৃত মালামাল সরবরাহের কথা বলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরেক দেশের তৈরি করা কম মূল্যের ও নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করে থাকে।

দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার মালামালের কথা বলে চীন বা ভারতের মালামাল সরবরাহ করা হয়। যেহেতু সর্বত্রই সিন্ডিকেটের লোকজন নিয়োজিত থাকে তাই এসব জাল-জালিয়াতি কোথাও বাধা পায় না। আর এভাবেই হাতিয়ে নেয়া হয় সরকারের কোটি কোটি টাকা। মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন মিঠু। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত। এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের ছেলে জিয়াউল হক ছিলেন মিঠুর বিজনেস পার্টনার।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন। কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে পুরো স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবিভর্‚ত হন মিঠু। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিনজন পরিচালকও মিঠু সিন্ডিকেটে যোগ দেন। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। আর বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তার ছেলের ওপর মিঠুর নিয়ন্ত্রণের কথাতো সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহর চিঠিতেই উল্লেখ রয়েছে!

সূত্র জানায়, মন্ত্রী-সচিবসহ স্বাস্থ্য খাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া নিচের পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। জানা গেছে, মিঠুর সিন্ডিকেটে স্থায়ী সদস্য হিসেবে আরো আছেন- কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের এক কর্মকর্তা, খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারী প্রমুখ। এই সিন্ডিকেটের কারণেই আলোচিত আবজাল হোসেন এত অর্থ সম্পত্তির মালিক হন। দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি ইউনিটে ভয়াবহ দুর্নীতি হলেও এ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব বিষয় নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনাই হোক না কেন, বহাল তবিয়তেই রয়ে যায় সিন্ডিকেট সদস্যরা।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একাধিক বার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মোবাইলে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। বিষয় উল্লেখ করে এসএমএস পাঠানো হলেও বুধবার দিবাগত রাত ৮টা পর্যন্ত কোনো প্রতিউত্তর দেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App