×

মুক্তচিন্তা

সকালে সূর্যের দেখা মিলবেই

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২০, ০৮:৪০ পিএম

মানুষের জন্য, যারা স্রষ্টার বুদ্ধি বিবেচনা ও মেনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে স্বীকৃত, এ এক অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই। আশা করা যাচ্ছে, একদিন না একদিন করোনাকে নির্মূল করার ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। কিন্তু এখানে প্রশ্ন একটাই- কবে?
মারণরোগের ভাইরাস বনাম মানুষ, এই দাবা খেলা চলছে মানবজাতির আদিযুগ থেকে। বহু মহামারি পেরিয়ে মানুষ বেঁচে আছে কেবল তার প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিরোধশক্তি দিয়ে। আজো বিশ্বে ১ হাজারের বেশি প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে। তাদের উপস্থিতি সর্বত্র, সর্ব জীবে। তবু আমরা বেঁচে আছি। এমনকি বাইরের কোনো সহায়তা, কোনো টিকা বা ওষুধ, কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করে আজ বেঁচে রয়েছেন অনেক মানুষ। তবে পূর্বেকার মহামারির চেয়ে কোভিড-১৯ খুবই ভয়ঙ্কর সংক্রমণ। অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুসারে, পৃথিবীর জনসংখ্যা যাতে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাড়তে পারে সেজন্য ইতিহাসে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর নিবীর্যকরণসহ (স্টেরিলাইজেশন) অনেক ধরনের নিষ্পেষণ চালানো হয়েছিল। ১৮৪০ সালে আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের সময়ে ব্রিটিশ সহকারী অর্থমন্ত্রী চার্লস ট্রেভেলিয়ান বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা কমানোর প্রাকৃতিক উপায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে ক্ষমতাধরেরা আরো ধুরন্ধর হয়েছে। হিটলার থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ক্ষমতাধরেরা শুধু দুর্ভিক্ষের আশায় বসে না থেকে, হয় নিজেরাই পরোক্ষভাবে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে। নয় তো নিজের ক্ষমতা দিয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ করে লাখ লাখ মানুষ মেরেছে। সবই দুর্বলকে সংখ্যায় আরো দুর্বল করে ম্যালথাস বা ডারউইনের তত্ত্বে বিশ্বাসী সবল জাতিকে আরো শক্তিশালী করে তাদের ভবিষ্যৎ। প্রজন্মকে পৃথিবীর আধিপত্য দিয়ে রাখার পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫। এই ২০ বছরে ভিয়েতনামে কত মানুষ মারা গিয়েছেন, জানেন? দক্ষিণ আফ্রিকার ভিয়েতনাম দূতাবাসের সূত্র মতে, শুধু সাধারণ মানুষই মরেছে ২০ লাখের চেয়ে বেশি। এর জন্য দায়ী কে? সেই ১৯৬৪ সাল থেকে দুর্বল প্যালেস্টাইনে চলছে লাশের শোভাযাত্রা। ১৯৭১-এর ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশে হত্যা করেছে ৩০ লাখ মানুষ। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে পরাশক্তিগুলোর সামনে মানুষ মরেছে কুকুরের সঙ্গে খাবারের লড়াইয়ে। ইরান-ইরাক যুদ্ধে শুধু নিহতই হয়েছে ৩ থেকে ৫ লাখ লোক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকাতে ৩ হাজার প্রাণ সংহারের জের ধরে গত ১৮ বছরে চোখের সামনে দিয়ে ইরাক-আফগানিস্তানে ঝরে গেছে লাখ লাখ প্রাণ। লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনে মানুষ হরদম মরছে গুলি আর বোমায়। নয় পালাতে গিয়ে মরছে জলে ডুবে। এ যেন কোন উপায়ে মারা যেতে চাও, তার লটারি! মনে আছে সেই সিরিয়ান শিশুটির ভেসে আসা মৃতদেহের কথা? একটি সূত্র মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতিগত সংঘর্ষ বা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি। আমার ধারণা, এ সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি। ভিটে হারানো লোকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ৮০ লাখ প্রাণ হারানোর দায় কার? এ সভ্য(?) মানবজাতির নিশ্চয়ই। সেই সভ্য জাতির একজন সদস্য হয়ে এর দায় থেকে তো আমি মুক্তি পেতে পারি না। পারি কি? করোনার দাপটে বিপর্যস্ত এ বিশ্বের চট্টগ্রাম নামক এক শহরের একটি ঘরের ভূতলে লুকিয়ে আছি আজ প্রায় দুই মাসের বেশি সময়। লুকিয়ে থেকে ভাবছি, সমুদ্রতীরে উপুড় হয়ে থাকা মৃত সিরিয়ান শিশুটির কথা। ভাবছি মৃত বাবার পিঠে রিওগ্রান্ডে ভেসে আসা দুবছরের সালভাদরিয়ান শিশুর অসাড় দেহটির কথা। কী অবলীলায় আমরা ভুলে যাই ওদের। যেন কিছুই হচ্ছে না কোথাও। সৌদি-মার্কিন বোমায় ক্ষত-বিক্ষত ইয়েমেনির লাশ পড়ে থাকে আমার চোখের সামনে। একটু জলের জন্য হাহাকার করে মরে আহত স্বজন তার। আর আমি কমলার রসে ঠোঁট ভিজাই। তুরস্কের নিক্ষিপ্ত গোলায় কুর্দি পরিবার মিশে যায় সৃষ্টিকর্তার জমিনে। ধুলোবালি আর ধোঁয়ার বহর ওড়ে। আমি কফির মগে ধোঁয়া তুলি। ইসরায়েলি বিমান হানায় গাজায় জ্বলে দাউ দাউ আগুন। আদিম মানবের আগ্রাসী ফলায় ছিটকে পড়ে কারো হাত, কারো মাথা আর কারো উরু। আমি মুরগির রানে কামড় বসাই। আমি ধরে নিয়েছি, এসব স্বাভাবিক। আমি, আমি আর আমি। সারা দিন শুধু আমি ছুটি, আমার পেছনে। তাই এটা আমার শাস্তি। এ শাস্তি আমাকে ভোগ করতেই হবে। আমি-আমি, আমার-আমার করতে গিয়ে এ বিশ্বকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছি আমরা। ভিয়েতনামে যে পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার ধ্বংসলীলা হিরোসিমা-নাগাসাকির থেকে ৭০০ গুণ বেশি। ফাটেনি এমন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ওদের লাগবে ৩০০ বছর। ফসলি জমির বিনাশ হয়েছে বেশুমার। যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্য দেশগুলো সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন আজ শ্মশানের মতো। যেন মৃত্যুপুরীর ভাস্কর্য। মায়ানমারের আরাকানে খাঁ খাঁ করছে রোহিঙ্গা বসতিগুলো, প্রায় ১২ লাখ মানুষ হাজার বছরের প্রাচীন জনবসতি ছেড়ে নাফ নদের তীরে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত বুভুক্ষু জনগোষ্ঠী, মেডিটেরিয়ানের তীরে ভেসে আসা কৃশকায় লাশের সারি, এসবই হচ্ছে সভ্য মানবজাতির অসভ্য লালসার ফসল। সে লালসার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। আমরা পৃথিবীর বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি সিএফসি, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড। সমুদ্রের লোনা জলে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, কৃষকের ভিটে, আর জেলেদের সংসার। লাল নীল কাঁকড়ারা আজ আমাদের সৈকতে আসে না। কচ্ছপেরা হারিয়ে গেছে দূর সমুদ্রে। ঘন কুয়াশার চাদর আজ বিলীন হয়েছে ধুলোর আস্তরণে। প্রকৃতি কি এর শোধ নেবে না? মানুষ যেমন প্রকৃতির অংশ, অন্য সৃষ্টিও তাই। করোনার প্রকোপে অন্য সৃষ্টি মেতেছে জীবনের জয়গানে। লাল নীল কাঁকড়ারা নৃত্যে মেতেছে কক্সবাজার ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে বালুচরে। আর এখন প্রকৃতি সৃষ্ট করোনা ভাইরাস! কাবু করে ফেলেছে সমগ্র পৃথিবী। সে আমেরিকা, চীন, জাপান, ব্রিটেনের কোনো মারণাস্ত্র কিংবা পারমাণবিক অস্ত্রকে ভয় পায় না। এসব দেশে আক্রান্ত আর মৃত্যের হার সবচেয়ে বেশি। এর ঠিক এমনো বলা যাচ্ছে না মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে। না, এখনো সঠিকভাবে, কোনো দেশ এত চেষ্টা আর গবেষণার পরও করোনা ভাইরাস দমনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। মানুষের জন্য, যারা স্রষ্টার বুদ্ধি বিবেচনা ও মেনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে স্বীকৃত, এ এক অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই। আশা করা যাচ্ছে, একদিন না একদিন করোনাকে নির্মূল করার ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। কিন্তু এখানে প্রশ্ন একটাই- কবে? ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, রাত যত ভয়াল আর অন্ধকারময় হোক না কেন, সকালে সূর্যের দেখা মিলবেই। আমিও আশাবাদী মানুষ। এ সংকট একদিন চলে যাবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সংকটের সময়ে আমরা কী আচরণ করেছি ও কী শিক্ষা নিয়েছি, সেটাই বড় হয়ে থাকবে। জামাল উদ্দিন : লেখক, প্রকাশক ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App