×

অর্থনীতি

জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কতটা সম্ভব!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২০, ১১:৩৬ এএম

করোনা ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে সবকিছু। মহামারির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। দেশের অর্থনীতির সব সূচক তলানিতে। এমন সংকটের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী ও দেশি-বিদেশি থিংকট্যাংকগুলো যেখানে বলছে প্রবৃদ্ধি তলানিতে নামবে; সেখানে বাংলাদেশ সরকার ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মনে করেন এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে না। অনেকের মনে প্রশ্ন, আসলেই কি তাই? অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, জিডিপির এই লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব ও হাস্যকর। করোনা ভাইরাসের চলমান পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক মন্দা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিবিএসের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হার চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০০৮ সালের বিশ^ব্যাপী মন্দার পর থেকে সর্বনিম্ন। বর্তমানে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখী। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে সরকার বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ঋণের ওপর। এমন প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্যেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরে আছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এটি আছে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যে কাঠামোর কথা বলা হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা মহামারির এ সময়ে সরকারের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেদিকে গুরুত্ব দেয়া, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আবারো গতি ফিরিয়ে আনা। তিনি বলেন, সরকারের এমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে মনে হচ্ছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির প্রতি তাদের যে মোহ, সেটিই ঘুরেফিরে সামনে চলে আসছে। ড. মুস্তাফিজ বলেন, করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সবগুলো দেশ যারা অর্থনৈতিকভাবে চাপে রয়েছে, তারা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত নয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জিডিপির যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে দেখা গেছে, অনেক বড় অর্থনীতির দেশও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। একই অবস্থা আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও বড় অর্থনীতির দেশ চীনে। ফলে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে চিন্তার সময় এখন নয়। এখন আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে নজর দেয়া উচিত। বাজেটের লক্ষ্যের সঙ্গে বাস্তবের অনেক ফারাক রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল- কীভাবে আমরা বর্তমান সংকটকে কাটিয়ে উঠব। যদি বেঁচে থাকি তবে অনেক পরিকল্পনা করতে পারব। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, বিগত এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত হারে বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমকি ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা এশিয়ার সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি ছিল শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ফলে বিশ^ব্যাপী দীর্ঘসময় ধরে চলা লকডাউনের কারণে রপ্তানি কমায় এবং প্রবাসী আয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে করোনা পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি সরকার ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর মতে, প্রবৃদ্ধির হার অনেক কম হবে। সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার আড়াই শতাংশের বেশি অর্জিত হবে না। বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া ইকোনোমিক ফোকাস গ্রুপের হিসেব অনুযায়ী, এ হার কোনোক্রমেই ২ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশের বেশি হবে না। বিশ^ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সরকার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করলেও বিশ^ব্যাংক বলছে, করোনার কারণে নতুন অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ শতাংশ। গত ৮ জুন বিশ^ব্যাংক তাদের এক পূর্বাভাস প্রতিবেদনে এসব জানিয়েছে। করোনার অদৃশ্য থাবায় দেশের শিল্প খাত ও সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই কঠিন হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য এ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অলীক স্বপ্নের মতো মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ অতি উচ্চাভিলাষী। করোনার কারণে যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির, সেই অবস্থায় চলতি অর্থবছরের জিডিপি অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত ছিল। এ বছর যদি আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, তবে তার চেয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে কখনোই এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। মাঝে কিছুটা সময় প্রবৃদ্ধি অর্জন কম হয়েছে। তবে ২০০০-০১ সাল থেকে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর অর্জিত হয়েছে। ২০০০-০১ অর্থবছর থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর সময়কালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চূড়ান্ত হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধির রেকর্ড গড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়। এ প্রবৃদ্ধির চলতি মূল্য ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি ডলার। একই সময়ে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ শতাংশের ওপরে। অথচ কোভিড-১৯ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App