×

মুক্তচিন্তা

ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার বাজেট এবং শিক্ষা খাত

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২০, ০৮:৫৭ পিএম

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ অপ্রতুল। তাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে সেদিকে নজর দিতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনলাইনে কোলভোরেটিভ লার্নিং করা কঠিন। এখানে ন্যূনতম একটি ট্যাব প্রয়োজন। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে।

ক্ষুদ্র এক ভাইরাস বদলে দিয়েছে অর্থনীতির হিসাব। মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে এই ভাইরাস। জীবন ও জীবিকার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করে আপাতত টিকে থাকার চেষ্টা করছি সবাই। কঠিন এই বাস্তবতার মধ্যে বৈশ্বিক মহামারিতে টিকে থাকা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক দিকনির্দেশনায় গত ১১ জুন আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। যেহেতু আগামী অর্থবছর ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছর সেহেতু এই বাজেটের বাস্তবায়ন গুরুত্ব পাবে আমি আশা করি।

করোনার কারণে উদ্ভূত এই বিশেষ পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই শিক্ষা খাতে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার আগে এই বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বাজেটে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী সবাইকে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, করপোরেট কর কমানোসহ নানা খাতে কর ছাড় দিয়ে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিদেশফেরত বেকার প্রবাসীদের পরিবারের বোঝা যাতে হওয়া না লাগে সেজন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পৃথক বরাদ্দ রেখেছেন। এ বরাদ্দ থেকে ঋণ পাবে বেকাররাও। বাজেটে মধ্যবিত্তদের কথা বিবেচনা করে কমানো হয়েছে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কর। যার কারণে এসব পণ্যের দাম কমবে বলে আশা করা যায়। নিম্ন ও প্রান্তিকদের জন্য আগামী অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানো হয়েছে। বাজেটের ১৭ শতাংশই এ খাতের জন্য রাখা হয়েছে। পুরো বাজেট বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় বাজেটে অর্থমন্ত্রী যথেষ্ট মানবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

এবারের বাজেটে কর্মপন্থার যে চারটি প্রধান কৌশলগত দিক নির্ধারণ করা হয়েছে তাও চোখে পড়ার মতো। প্রথম কৌশলে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য এবং বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় কৌশলে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণের কথা বলা হয়েছে যা করোনার এই দুর্যোগ কাটিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। তৃতীয় কৌশলে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি। যা করোনার এই দুর্যোগে হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হবে। চতুর্থ কৌশলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এই কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যাতে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে অর্থমন্ত্রী সতর্ক রয়েছেন বলে বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।

জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করাই বর্তমানে আমাদের কৃষি খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই যাতে খাদ্য সংকট সৃষ্টি না হয়। সেজন্য এক ইঞ্চি আবাদি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় ও তার সব সহযোগী সংস্থাকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুর্যোগকালীন এই বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কৃষিতে। কৃষির দুটো দিক থাকে একটি হচ্ছে উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যটি ফসল ঘরে তুলে আনা। ফসল রক্ষণাবেক্ষণ, ফলন বাড়ানো ও নিরাপদে ফসল ঘরে তুলে আনতে হলে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। এই কারণে এবারের বাজেটে কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি কৃষি উৎপাদনের যান্ত্রিকীকরণটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) ব্যবহার কৃষি ফলনকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এ স্নাতক পর্যায়ে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীদের অর্জিত মেধাকে কাজে লাগিয়ে এ কাজে সফলতা পাওয়া যেতে পারে। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মানবসম্পদ উন্নয়ন (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট) খাতে ২৮.০৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ২২২ কোটি টাকা। করোনার কারণে এবার স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কৃষিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে দরিদ্র কর্মজীবী মানুষের কষ্ট কমাতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানোকে তৃতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। চতুর্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন আর্থিক ও প্রণোদনামূলক কার্যক্রমের ওপর।

তারপরই রয়েছে শিক্ষা। সবকিছুতেই শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণে দক্ষ জনবল তৈরিতে যেমন ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, ঠিক তেমনি করোনার এই ভয়াল থাবা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচতে দক্ষ ডাক্তার ও নার্স তৈরিও প্রয়োজন। এবারের বাজেটে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু যথাযথ বাস্তবায়নের। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ভিত্তি হলো প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষা। এবারের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। করোনার কারণে এখানকার শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে সেই বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার প্রসারে সরকার ইতোমধ্যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। দেশে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১৫০টি। এখানে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। এই স্তরের শিক্ষাকে আরো বেগবান করতে এখন জোর দেয়া হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার ওপর। বাজেটে উপযুক্ত আর্থিক সুবিধা এবং আধুনিক প্রশিক্ষণকে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এখন করোনার এই দুর্যোগে যেহেতু শিক্ষার্থীরা সরাসরি শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না তাই গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ডিজিটাল পাঠদান পদ্ধতির দিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক শিক্ষার্থীর ডিজিটাল বা অনলাইনে ক্লাস করার মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকতে পারে সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। অনলাইনে ক্লাস করে ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করার সক্ষমতা আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর এখনো নেই সেদিকেও আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ অপ্রতুল। তাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে সেদিকে নজর দিতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনলাইনে কোলভোরেটিভ লার্নিং করা কঠিন। এখানে ন্যূনতম একটি ট্যাব প্রয়োজন। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে।

করোনার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে মানবসম্পদের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। যার কারণে অর্থমন্ত্রী কৃষি, স্বাস্থ্য এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে এবারের বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি এই বাজেটে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করা হয়েছে। করোনার কারণে যেসব খাতকে গুরুত্ব দেয়া দরকার সেসব খাতে বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে মানবসম্পদ তৈরি করার লক্ষ্যে শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App