×

সাহিত্য

অবরুদ্ধ সময়ে ছবি আঁকছি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২০, ০৯:৫৮ এএম

অবরুদ্ধ সময়ে ছবি আঁকছি

চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা

অবরুদ্ধ সময়ে ছবি আঁকছি

চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা।

অবরুদ্ধ সময়ে ছবি আঁকছি

করোনাকালে শিল্পীর ঘরবন্দী সময়।

অবরুদ্ধ সময়ে ছবি আঁকছি

না বলা প্রাণীগুলোর জন্যও শিল্পীর মায়া-দরদ।

বিশেষ সাক্ষাৎকার কনকচাঁপা চাকমা চিত্রশিল্পী

কনকচাঁপা চাকমা। চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের চিত্রকলায় সমতলের পুরুষপ্রধান সমাজের ভাবনা উপেক্ষা করে রাঙামাটির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, কলাকৌশল ও আঙ্গিকের সমন্বয় ঘটিয়ে সমকালীন চিত্রকলায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।

শৈশব-কৈশোরে প্রকৃতি, পাহাড়, অরণ্য ও হ্রদের সৌন্দর্যের সঙ্গে বেড়ে ওঠা কনকের মননশীল মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের চিত্রকলাচর্চায় কনকচাঁপা সব সময়ই নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদের সংস্কৃতি ও যাপিত জীবনকে ধরতে চেয়েছেন। আবার একই সঙ্গে অশান্ত পাহাড়, জাতিগত অস্তিত্বের লড়াই, পাহাড়ি-বাঙালি বৈরিতা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মারণাস্ত্র এসব বিষয় তার সরল জীবনযাপনে স্পষ্ট টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। তারপরও আদিবাসী জীবনযাত্রা, পাহাড়ি নিসর্গ ইত্যাদি নানা অভিজ্ঞতা বিচ্ছুরিত হয়েছে তার চিত্রকলায়। বুদ্ধের অহিংস বাণীদ্বারা প্রভাবিত শিল্পী কনক পৃথিবীর এই অশান্ত পরিবেশে শান্তি পৌঁছে দিতে চান সৃজনশীলতা দিয়ে। ধর্ম নয়, মানবতার প্রতি মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ দেখতে চান।

[caption id="attachment_225946" align="aligncenter" width="1024"] করোনাকালে শিল্পীর ঘরবন্দী সময়।[/caption]

তার শিল্পে নারী একটি সার্বভৌম চরিত্র, এটা আদিবাসী সামাজিকতার অংশ হলেও তিনি জানেন এই নারীদের দুঃখগাথা। নারীরাই সমাজ, সংস্কৃতি ও সমস্ত কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে থাকার পরও তাদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যে তিনি ব্যথিত হন। তারপরও কনকচাঁপা স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে ভালোবাসেন। তাই তার ছবিতে লাল-হলুদ-নীলের প্রাধান্যের সঙ্গে যে রীতি দাঁড়িয়েছে স্বকীয়তা নিয়ে, তার মধ্যে চাকমাজীবনের রূঢ় বাস্তবতা নয়, বরং আনন্দময় সুন্দর মুহূর্তগুলোর চিত্রায়ন ঘটেছে খানিকটা সুখস্বপ্ন দেখার অভ্যাসের মতো। ব্যস্ত এই শিল্পী নিজের ছবি বিক্রি করে করোনাকবলিত অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই মানুষটি।

তার করোনাকাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনার এই অবরুদ্ধ সময়ে ছবিই আঁকছি। মোটেও করোনাকালীন ছবি নয়। আমি সাধারণত যা আঁকি আমার আদিবাসীদের জীবনচিত্র, তাই আঁকছি। এসবে হয়তোবা কিছুটা কালারে ও কম্পোজিশনে পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ডিপ্রেশনে ভুগছি। তবে তা আমাকে খুব বেশি কাবু করতে পারে না। কারণ ছবি তো একধরনের ক্রিয়েশনই। আমি এর ভেতর নিজেকে মগ্ন করে রাখতে পারি। এর পাশাপাশি আমার ১১টা বিড়াল এবং দুটো কুকুর আছে। ওরা আমাকে সাংঘাতিকভাবে ব্যস্ত রাখে। এত বেশি আনন্দিত করে রাখে, আমার কষ্টের এবং খারাপ লাগার সময়টা অনেকখানি দূর করে দেয়। আমার মনে এটা মানুষের মেন্টাল থেরাপি। মানুষের ভেতরের বিষাদগ্রস্ততা ওরা বেশ টেনে নিতে পারে। ওদের সঙ্গে হইচই দৌড়ঝাঁপ করেই কেটে যাচ্ছে সময়।

[caption id="attachment_225884" align="aligncenter" width="700"] চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা।[/caption]

সাধারণ ব্যস্ততার কারণে আমি ওদের সময়ই দিতে পারি না। আড়াই মাস ধরে রাতে দিনে আমাকে এতটা সময় কাছে পেয়ে ওরা সাংঘাতিক খুশি। এর পাশাপাশি আমি টুকটাক রান্না করি। আগে আমার স্বামী বেঁচে থাকতে রান্না করতে বেশ পছন্দ করতাম। সে চলে যাওয়ার পর রান্না করাটা এনজয় করি না। কিন্তু এখন সময়টাকে আমার ভালোভাবে পার করতে হবে এজন্য কিছুটা সময় ওইদিকে ব্যয় করি। যদিও রান্না করার মানুষ আছে। তারপরও চাই, আমার ছেলে যেটা পছন্দ করে এবং আমি নিজে যা খেতে চাই তা করার চেষ্টা করি। জাস্ট সময়টাকে ধরে রাখা। ওই সময় যাতে আমাকে ব্যথিত করে না তোলে। লকডাউনের সময় আমি যেন হতাশার মধ্যে ডুবে না যাই। তাই ছবি আঁকা যেহেতু আমার ক্রিয়েশন, এ সবের পাশাপাশি প্রতিদিন একটানা পাঁচ ছয় ঘণ্টা পড়ছি। এর মধ্যে অনেক ছবি এঁকেছি। সেই সঙ্গে প্রতিদিন রাতে একটা সিনেমা দেখি। তা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিলিয়ে। তবে আর্ট ফিল্মগুলো বেশি দেখি। এছাড়া প্রচুর গান শুনি। যন্ত্র সংগীতও শুনি। একটা সাংগীতিক পরিবেশেই ছবি আঁকতে আমার ভালো লাগে। এছাড়া প্রচুর বইও পড়ি। এখন পড়ছি সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা ‘জীবনের গল্প’। সত্যজিৎকে কাছে থেকে দেখার অনেক স্মৃতি। পড়ে বেশ ভালো লাগছে। একটু লেখালেখিরও অভ্যাসও আছে।

আমি এখন লিখছি মা শরৎ মালা চাকমাকে নিয়ে। তিনি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন বুননশিল্পী। আন্তর্জাতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়েছেন এবং তার কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। সাত বছর বয়স থেকে তিনি বুনন শিল্পের কাজ করছেন। মায়ের সেসব কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখছি। কারণ তার বয়স এখন ৮৭ বছর। রাঙামাটিতেই থাকেন। এখনো বুননের কাজ করেন। এই লকডাউনের পুরোটা সময় তিনি আমার সঙ্গে ঢাকাতেই ছিলেন। তখন তার স্মৃতি থেকে থেকে অনেক কিছু জেনে লেখার চেষ্টা করছি। মায়ের ওপর একটা তথ্যচিত্র করছে আমারই এক জুনিয়র শিল্পী।

[caption id="attachment_225947" align="aligncenter" width="1024"] বাকহীন প্রাণীগুলোর জন্যও শিল্পীর মায়া-দরদ।[/caption]

আপনি তো প্রকৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন, আপনার চেনা পৃথিবীর কতটা বদল ঘটেছে বলে মনে করছেন? এর জবাবে এই প্রকৃতিকন্যা বলেন, করোনার অভিঘাতে পৃথিবীটা আমূল বদলে গেছে। এর পরবর্তী সময়টায় আমরা আরো পরিবর্তন আমরা দেখব। এর গতি প্রকৃতি এখনো আমরা জানি না। তবে এটুকু আমি অনুভব করছি, যেহেতু আমি প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়েছি, প্রাণির মধ্যে বড় হয়েছি।

আমার মনে হচ্ছে, মানুষ এত বেশি প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলেছে, হয়ত এটা কাম্য নয়। পৃথিবীটাকে আমাদের বসবাসের যোগ্য করে রাখা উচিত ছিল। সেখানে আমরা তা না করে মানুষ যুদ্ধ থেকে শুরু করে বোমা বানানো থেকে শুরু করে সমুদ্র, বন, নদী সব কিছুকে পলুটেড করে ফেলেছে। অরণ্য উজাড় করে ফেলেছে। যেখানে প্রাণীরা থাকতে পারছে না।

অথচ এই প্রকৃতিটা তো সৃষ্টিই হয়েছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য। প্রাণীগুলো আছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য। এগুলো তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। এসবকে সম্মান করতে হবে। ভালোবাসতে হবে। কিন্তু আমরা তা করি না। আমরা কেবল ধ্বংস করি আর পেতে চাই। পেতে হলে তো কিছু দিতে হবে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এই যে করোনাকালে মানুষ ঘরে ঢুকে গেছে, এতে প্রকৃতি নিঃশ্বাস ফেলছে আর বলছে- ‘মানুষের চাপ নেই’।

আরেকটা বিষয় বেশ উপলব্ধি করছি, করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কাছে ধনী-দরিদ্র, বড় দেশ, ছোট দেশ, সীমানা কোনো কিছুই ভেদাভেদ নেই। কাউকেই মানছে না। তবে, আমি স্বাপ্নিক এবং ইতিবাচক মানুষ। এটা মহামারি হলেও আমরা ওভারকাম করতে পারব। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা মোকাবিলা করেছি, রুখে দাঁড়িয়েছি, ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এবারো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App