×

অর্থনীতি

বিনিয়োগে আকাশচুম্বি স্বপ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২০, ১০:০৯ এএম

করোনা ভাইরাসের কারণে এখনই থমকে গিয়েছে অনেক কিছু। বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। করোনায় দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক তলানিতে। এমন সংকটের মধ্যেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে বড় ধরনের স্বপ্ন দেখছে সরকার। আশা করছে আগামী অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি দ্বিগুণ বিনিয়োগ ঘরে তুলবে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের ১২ দশমিক ৭২ শতাংশের বিনিয়োগ আগামী অর্থবছরে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চায় সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা উঁচু তলায় বসে স্বপ্নে দেখার মতো, যা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাদের মতে, এমনিতেই করোনার কারণে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান সক্ষমতাই ব্যবহার করতে পারছে না। সেখানে নতুন করে কীভাবে এত বিনিয়োগ হবে। প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকার আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট জিডিপির ২৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চায় যা চলতি অর্থবছর হয়েছে মাত্র ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি বিনিয়োগ হবে দিগুণ। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ ৩ মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। এ কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়। সংশোধিত মোট লক্ষ্য ধরা হয় ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ০৮ করা হয়। আর বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ শতাংশ কমিয়ে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ করা হয়। ব্যক্তি খাতে সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে বাড়বে এ বিষয়ে গত শুক্রবার বাজেটোত্তর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশে ১০০ অর্থনৈতিক জোন প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৭টির কাজ শেষের দিকে। করোনার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হবে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কার হবে। নতুন নতুন এলাকা চিহ্নিত হবে। সে সুযোগ আমরা নেব। মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের দরকার হচ্ছে এই মুহূর্তে দেশের মানুষকে বাঁচানো, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া। বিদেশে হোক বা এ দেশেই হোক, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আশা করি, আগামীতে ১০০টি ইকনোমিক জোনের মাধ্যমে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এখানে বিনিয়োগ আসবে। এছাড়া কর আদায়ের হার জিডিপির ১১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নিতে পারলে অর্থের অভাব হবে না। সে অর্থও বিনিয়োগে আসবে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় শিল্পে বিনিয়োগ করে এ সুবিধা নিতে পারেন। আমাদের দরকার মানুষকে বাঁচানো। এতদিন বুঝতে পারিনি কেন বিদেশি বিনিয়োগ কম আসে। এখন বুঝতে পারছি। এজন্য সবকিছু খোলাসা করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যেত। আগামীতে সেটি আর হবে না। একটি প্রতিযোগিতামূলক সুদ হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কমবে না। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর মূল্যায়ন করতে গিয়ে গত শুক্রবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) জানিয়েছে, সরকার যদি আগামী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ অর্জন করতে চায়, তবে চলতি মূল্যে বিনিয়োগ হতে হবে ১২৫ শতাংশ। যেটা বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ^ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনা সংকট কবে বিদায় নেবে তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের দেশে ব্যবসার পরিবেশ, অবকাঠামো দুর্বলতাসহ নানা কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। সেখানে এক লাফে এক বছরে দিগুণ বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ কীভাবে এ বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় তার দিকনির্দেশনা নেই। তিনি বলেন, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা উঁচু তলায় বসে স্বপ্নে দেখার মতো, যা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। মির্জা আজিজ বলেন, করোনার কারণে আগামীতেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকবে। এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারে না। এমনিতেই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। এরপর নতুন বিনিয়োগ হওয়া খুবই কঠিন। মির্জ্জা আজিজ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত। তার মতে, বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। জানা যায়, একটি দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ কেমন তার ওপর নির্ভর করে সেদেশে বিনিয়োগ কতটা হবে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচক বলছে, এক্ষেত্রে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২ অঙ্কের ঘরে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য মৌলিক পূর্বশর্ত ৭টি। এগুলো হচ্ছে পুঁজির সহজলভ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, পর্যাপ্ত জমি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থিতিশীল কর কাঠামো, দক্ষ শ্রমিক এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সহজ ব্যবস্থাপনা। সাধারণত কোনো শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ হলে সেখানে কর্মসংস্থান হয়। কর্মসংস্থান হলে উৎপাদন বাড়ে। বছর শেষে তা জিডিপিতে যোগ হয়। কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতিবিদরা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির কথা বলে আসছেন। দেশে এক দশক ধরে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, প্রতি বছর শ্রমবাজারে ২০ লাখ মানুষ এলেও সবার কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না। এতে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়ে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তেমন কিছু নেই বলে জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ পরিকল্পনায় আমরা উল্লম্ফন দেখেছি। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার কথা ভাবা উচিত। এমনিতেই ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো অনেক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ৮৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নেবে। আর সরকার এ পরিমাণ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে অর্থের সমস্যা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App