×

মুক্তচিন্তা

জেআরসি কমিটির পর্যবেক্ষণ কর্মকাণ্ড ও সুপারিশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২০, ০৬:১৯ পিএম

বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল খাতে প্রণোদনা বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে কমিটি মনে করে। এই পরিস্থিতিতে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚ত আইটি পেশাদারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের বাছাইকৃত স্থানে সেমিনার ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা।

আমাদের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী গত ১ মে শেষ নিশ্বাস (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন) ত্যাগ করার পর আমি এই কলামে তাকে নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে জেআরসি কমিটি নামক একটি জাতীয় কমিটির তথ্য দিয়েছিলাম। তাতে কমিটি গঠন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ আলোচনা করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে প্রফেসর চৌধুরীর সঙ্গে যুক্ত সেই কমিটি এবং তার কর্মকাণ্ড, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। আজকের লেখাটি সেই লেখারই ধারাবাহিকতায় লেখা)

জেআরসি কমিটি সফটওয়্যারের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ রিপোর্ট তৈরির আগের এক বছরে সফটওয়্যার সম্পৃক্ত প্রযুক্তি খাতে বিশ্ববাজার ছিল ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ খাত থেকে আয় করেছে ১০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ’৯৬ সালে প্রযুক্তি খাতে মার্কিন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা সাড়ে ১২ ভাগ। একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাড়া বিশ্বে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়। পরবর্তী চার বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ প্রোগ্রামার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ভারতীয় বাণিজ্য সংগঠন নাসকমের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানি থেকে শূন্য দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে। খুবই লক্ষণীয় বিষয় যে, ভারত সফটওয়্যারের শিল্প খাতে তখনো ব্যাপকভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর অধিক নির্ভরশীল। তখনো তাদের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার হয়নি। কিন্তু রপ্তানি বাড়ানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা ছিল ব্যাপক। জেআরসি কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, এই অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত বিকাশমান দেশ বিশেষ করে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইনের কর্মকৌশল ও সরকারি নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করতে সেসব দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাবে। পরবর্তীতে সময়ের স্বল্পতা বিবেচনায় শুধু ভারতে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। সরকার জেআরসি কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেঁধে দিয়েছিল দুই মাস। অবশ্য কমিটির কাজের পরিধি বিবেচনায় অতিরিক্ত আরো ছয় সপ্তাহ মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেআরসি কমিটির একটি প্রতিনিধিদল ভারতে শিক্ষা সফর করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরুর এবং কলকাতায় ভারতের শীর্ষ সফটওয়্যার শিল্প বিশেষ করে সফটওয়্যার এক্সপোর্ট হাউস, ডেটা এন্ট্রি এক্সপোর্ট হাউস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক পরিদর্শন করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। সফরকালে প্রতিনিধিদল সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে তাদের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়াও জেআরসি প্রতিনিধিদল ভারতে ৯ থেকে ১০ হাজার জনবল সমৃদ্ধ কোম্পানি যারা বিস্তৃত স্পেকট্রামে কাজের সঙ্গে জড়িত সেই ধরনের বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। কমিটির অপর একটি প্রতিনিধিদল ঢাকার মিরপুরে বিসিক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। প্রতিনিধিদলটি ঢাকার অদূরে নবনির্মিত টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কের পাশে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা নিরীক্ষার জন্য সাইট পরিদর্শন করে। জেআরসি কমিটির কর্মকাণ্ড ও সুপারিশ : কম্পিউটার সফটওয়্যার সার্ভিসে ভারতের বিশাল সফলতার পেছনে যে বিষয়গুলো কাজে লাগিয়েছে জেআরসি কমিটির সদস্যরা সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে চিহ্নিত করেন। সেই আলোকে কমিটি তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে কমিটি চারটি খাতে মোট ৪৫টি সুপারিশ তৈরি করে। জেআরসি কমিটি আর্থিক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং বাজারজাতবিষয়ক চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। চিহ্নিত প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিটি পৃথক পৃথকভাবে সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সরকারের আশুকরণীয় নির্ধারণ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে এই সুপারিশমালা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা প্রযুক্তি বিকাশের বিস্ময়কর সূচনা এগিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারি। জেআরসি কমিটির নিরলস প্রয়াস পৃথিবীতে চলমান তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে ভারতের দুই দশক পরে হলেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। এর আগে কোনো শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশ শরিক হতে পারেনি। প্রায় সাড়ে তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল কমিটির এই রিপোর্টটি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। আর্থিক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও ডিজিটাল পণ্য বাজার বিষয়ক কমিটি চিহ্নিত এই চারটি ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে সরকারের কাছে পেশ করা সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে রিপোর্টে সেই বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়। সুপারিশসমূহের গুরুত্বের বিচারে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমমেয়াদি এই দুই ভাগে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করে। প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনার সুপারিশ কমিটি করেনি। কমিটি আর্থিক খাতে ১০টা, মানবসম্পদ খাতে ৯টা, অবকাঠামো খাতে ১৪টা এবং বাজারজাতকরণ খাতে ১২টা মিলিয়ে মোট ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে। নিচে সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হলো। আর্থিক খাত : আর্থিক বিষয়ে কমিটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে উচ্চ আমদানি কর ও ভ্যাটের কারণে কম্পিউটার সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে দেশে গ্রাহক পর্যায়ে কম্পিউটারের ব্যবহার হার খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত, কোনো প্রকার প্রণোদনা না থাকায় আমদানিকারকরাও কম্পিউটারের বাজার সম্প্রসারণে খুব বেশি একটা আগ্রহী নয়। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অতিরিক্ত সুদের হার (তৎকালীন শতকরা ১৫ থেকে ১৭ ভাগ) উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। চতুর্থত, ব্যাংক ঋণে বিদ্যমান দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া আমদানিকারকদের জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কমিটি চিহ্নিত করে। এই ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, কম্পিউটারের ওপর থেকে সব ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার, ১০ বছরের জন্য কর রেয়াত, স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সফটওয়্যারের জন্য শতকরা ১৫ ভাগ অভ্যন্তরীণ মূল্য সুবিধা প্রদান, সফটওয়্যার ও ডেটা প্রসেসিং সার্ভিস রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসির পরিবর্তে সেলস কনট্রাকট অনুমোদন প্রদান, রপ্তানি খাতে ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার সুবিধা নিশ্চিত করতে সুদবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্য তহবিল গঠন এবং আইটি গবেষণার জন্য তহবিল গঠন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মানবসম্পদ উন্নয়নে সুপারিশমালা : বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে বিভাগ স্তরে উন্নীত করে সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা, ১৯৯৯ সালের মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার প্রশিক্ষক তৈরি করতে বিসিসিকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান, স্নাতক স্তরে সব শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বেসিক কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে কমিটি। কমিটি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিআইটিএস এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিষয়ক ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা বাড়ানো, প্রতি দুই বছর অন্তর প্রয়োজনবোধে কোর্স কারিকুলাম পর্যালোচনা ও উন্নত করা, জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও সনদ ব্যবস্থা উন্নয়নে বিসিসিকে শক্তিশালী করা, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী আইটি পেশাদারদের জন্য চাহিদাভিত্তিক উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বিসিসিকে শক্তিশালী করে দায়িত্ব প্রদান এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে কমিটি সুপারিশ পেশ করে। অবকাঠামো খাত : সফটওয়্যারের জন্য কোনো কপিরাইট প্রোটেকশন না থাকায় কমিটি ডব্লিউটিও চার্টার অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ী উচ্চ গতির ডেটা এবং ভয়েজ কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপন, দেশে ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠা, সাশ্রয়ী দামে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা, ভিসেটের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা সহজলভ্য করার সুপারিশ করে। বিটিটিবির স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক ধীরগতি এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় বেসরকারি খাতকে নিজস্ব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন্স লিংক স্থাপনের সুযোগ প্রদান, বন্দরসমূহে ডিজিটাল পণ্যের কাস্টম ছাড়পত্র সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব পণ্য খালাসের প্রয়োজনে মনোনীত নির্ধারিত বন্দরে পৃথক সেল তৈরি, বিসিসিতে কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং ডেটা প্রসেসিং সার্ভিসে জড়িত প্রতিষ্ঠানসমূহকে এর আলোকে এসোসিয়েশন গঠনে উৎসাহিত করা, ডিজিটাল খাতের জন্য সার্বক্ষণিক ভিত্তিক ইপিবি থেকে একজন সহকারী পরিচালককে নিয়োজিত করার সুপারিশ করা হয়। জামিলুর রেজা কমিটি ঢাকার অদূরে টঙ্গী-আশুলিয়া রোডের সুবিধামতো স্থানে প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসহ ইনফরমেশন টেকনোলজি ভিলেজ বা আইটিভি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। পণ্য বাজারজাত খাত : বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল খাতে প্রণোদনা বিষয়টি অবহিত করার মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার লক্ষ্য অর্জনে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য বলে কমিটি মনে করে। এই পরিস্থিতিতে সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বাজারে তুলে ধরার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚ত আইটি পেশাদারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের বাছাইকৃত স্থানে সেমিনার ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা।

মোস্তাফা জব্বার : কলাম লেখক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App